২৫ জুলাই ‘বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ পানিতে ডুবে অকালমৃত্যু রোধ করতে হবে – হীরেন পণ্ডিত

0

পানিতে ডুবে অকালমৃত্যু কারোই কাম্য নয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪০০ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়। যাদের ২০ শতাংশের বয়স পাঁচ বছরের কম। এজন্যই বিশ্ব জুড়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুকে ‘নীরব মহামারি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশে এক থেকে চার বছর বয়সি শিশুদেও মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশের জন্য দায়ী পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। পানিতে ডুবে মৃত্যুর ১০ ভাগের এক ভাগ ঘটেছে নৌদুর্ঘটনায়। এছাড়াও ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১৭ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এ মৃত্যু সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

২৫ জুলাইকে বিশ্ব ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। দিবসটি ঘোষণার জন্য যৌথভাবে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ও আয়ারল্যান্ড। পাশাপাশি সমর্থন দিয়েছে জাতিসংঘের ৭৯টি সদস্য রাষ্ট্র। পানিতে ডুবে মৃত্যুকে একটি ‘নীরব মহামারি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি পানিতে ডুবে মৃত্যুহারকে শূন্যের কোটায় না আনতে পারি তবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় আমাদের সাফল্য অর্থাৎ এসডিজি-৩ অর্জন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পানিতে ডুবে মৃত্যু কেবল দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি বৈষম্য।

এশিয়াতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি এবং মোট মৃত্যুর ৯০ শতাংশই ঘটে বাংলাদেশের মতো মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশে। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন পানিতে ডুবে মারা যায়, যার মধ্যে ৪০ জন শিশু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া। কিন্তু এই মৃত্যু স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় কম খরচে প্রতিরোধ যোগ্য, যা গবেষণায় প্রমাণিত।

গবেষণায় দেখা গেছে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধ করতে পারে ৮২ শতাংশ। অন্যদিকে ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার শিখিয়ে তা প্রতিরোধ করা যায় ৯৬ শতাংশ। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে এই দুই উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। প্রতি বছর ২৫ জুলাই পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস পালনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ এ বিষয়ে অধিক সচেতন হবে এবং যথোপযুক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পানিতে ডুবে মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

প্রতি বছরই বর্ষা এলেই পানিতে ডুবে মৃত্যু দুর্ঘটনার হার যেন বেড়ে যায়। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই অঞ্চলে প্রলম্বিত বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণেই এত পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আমাদের চারদিকে রয়েছে প্রচুর জলাশয়, পুকুর, নদী, খালবিল। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, শহরের চেয়ে গ্রামে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার বেশি, অধিকাংশ শিশুই বাড়ি থেকে ২০ মিটার এবং কম বয়সিরা ১০ মিটার দূরত্বেও কোনো পুকুর বা জলাশয়ের মধ্যে পড়ে মারা যায়। পরিবারের ক্ষুদে সদস্যের ওপর সঠিক নজরদারির অভাবে এমন করুণ পরিণতি দেখা যায়। সংখ্যায় বলতে গেলে, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনার ৬০ শতাংশ ঘটনা সকাল নয়টা থেকে বেলা একটার মধ্যে হয়ে থাকে। কারণ এ সময় মায়েরা ব্যস্ত থাকেন গৃহস্থালি কাজে, বাবারা কাজের তাগিদে বাইরে থাকেন এবং ভাইবোন থাকলে তারা হয়তো স্কুলে বা অন্য কাজে থাকেন।

এ সমস্যা রোধে ইউনিসেফ ও কয়েকটি সংস্থার যৌথউদ্যোগে সারা দেশে কিছু প্রকল্প চলছে। এসব প্রকল্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন নারী শিশুদেও দেখভাল করেন। এছাড়াও সরকার সম্প্রতি পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
বৈশ্বিকভাবে এসডিজির অন্তভুর্ক্ত করা হলেও পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার আশানুরূপ হারে কমছে না। অসুস্থতাজনিত কারণে শিশুমৃত্যুর হার কমানো গেলেও সার্বিকভাবে শিশুমৃত্যুর উচ্চহার রয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পানিতে ডুবে মৃত্যুর ৪৭ শতাংশ তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। অথচ এসব মৃত্যু রোধে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানোর জন্য কিছু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দরকার।

এর মধ্যে থাকতে পারে পুকুরপাড়ে বেড়া দেওয়া, শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণে রাখা, সাঁতার শেখানো, পানি থেকে উদ্ধারের পরপরই শিশুদের স্বাভাবিক করতে সাহাঘ্য করা। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকেও ‘সাঁতার শেখার গুরুত্ব’ বিষয়ে অধ্যায় সংযুক্ত করা যেতে পারে। এছাড়া পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি ও জাতীয়ভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করার ওপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বারোপ করেছে।

মনে রাখতে হবে, বর্তমান সরকার পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ঠিকই, তবে শুধু সরকারি উদ্যোগে পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধ সম্ভব নয়; তাছাড়া পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা ছাড়াও ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতাহীন হলে এ মৃত্যু রোধ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সবাই মিলে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে, যাতে শিশুরা নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারে। পানিতে ডুবে মৃত্যুতে বাংলাদেশ বিশ্বে ২২তম। প্রথম আফ্রিকার গায়ানা। বাংলাদেশ ছাড়া প্রথম ২২টির ১৯টিই আফ্রিকার দেশ।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর পানিতে ডুবে সাড়ে ১৪ হাজার শিশু মারা যায়। এদের বয়স ১ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। এই বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ এখন পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘ডায়রিয়ায় মৃত্যু রোধে এবং এর ব্যবস্থাপনায় আমরা বিশ্বে এক নম্বর। গণটিকা দেওয়ার কারণে ডিফথেরিয়া বলতে গেলে নেই। ধনুষ্টঙ্কার একদম নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ করতে পারছি না আমরা। এ নিয়ে দেড় যুগ ধরে আলোচনা চলছে। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুদৃষ্টির অভাব আছে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০’-তে দেশে বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর চিত্র তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা যায়, ৫ বছরের কম বয়সী ৪৪ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। এরপরই পানিতে ডুবে মৃত্যুর স্থান। এটি প্রায় ৯ শতাংশ। এরপর আছে শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা, অপুষ্টি, নানা ধরনের জ্বর, জন্ডিস ও জটিল ডায়রিয়া। পানিতে ডুবে মৃত্যুর ৮০ শতাংশই ঘটে পুকুরে। ৮০ ভাগ পানিতে ডুবে মরার ঘটনা ঘটে বাড়ি থেকে ২০ গজের মধ্যে। ৬০ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে সকাল নয়টা থেকে বেলা একটার মধ্যে ২০১৬ সালে করা বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে অনুযায়ী, দেশে ১ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর (আঘাতজনিত) ৩৭ শতাংশই হয় পানিতে ডুবে। সে হিসাবে বছরে সাড়ে ১৪ হাজার শিশু ডুবে মারা যায়।

বিবিএসের ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসে ডুবে মারা যাওয়ার পরিসংখ্যানে শিশুর বয়স নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়ের অধীন বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভের তথ্যের সঙ্গে বিবিএসের তথ্যের ফারাক আছে। পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য বলছে, ১ মাস থেকে ১২ মাস বয়সীদের ক্ষেত্রে এটা সচরাচর ঘটে না। ১২ মাস থেকে ৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এটা বেশি হয়। হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে অনুযায়ী, এই বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতি ১ লাখে ৭১ দশমিক ৭ জন ডুবে মারা যায়। ৬ থেকে ৯ বছরের শিশুর ক্ষেত্রে এটা লাখে ২৮ দশমিক ১ জন।

শিশুমৃত্যু রোধ, পুষ্টি ইত্যাদি খাতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় বিনিয়োগ থাকলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তৎপরতা একেবারেই কম। যা-ও হয়, তা কিছু পাইলট কর্মসূচি। যেমন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আছে দুটি কর্মসূচি। দুটোই শিশুদের সাঁতার শেখানোর।
কিন্তু দেশে সবচেয়ে বেশি পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় বরিশাল বিভাগে। জাতীয় পর্যায়ে যেখানে লাখে ১১টি শিশুর মৃত্যু হয়, সেখানে বরিশাল বিভাগে এ সংখ্যা ৩৪। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বহু খাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২৫’-এ ১০ দফা লক্ষ্যমাত্রা তুলে ধরা হয়েছে। তাতে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে বিভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারণ নিয়ে কাজ করার কথঅ বলা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাড়ির ‘আশপাশের পুকুর-ডোবা যে সন্তানের জন্য মৃত্যুফাঁদ হয়ে আছে, বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা কম। আবার সাঁতার শেখানো বা প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মীর অভাব প্রকট। ফলে কমছে না মৃত্যু।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে ১০টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথা বলেছে তাদের নির্দেশিকায়। এগুলোর মধ্যে পুকুর-ডোবায় বেড়া দেওয়া এবং স্কুলগামী শিশুদের সাঁতার শেখানোর কথা বলা আছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পানিতে ডুবে যাওয়ার বিষয়টি যুক্ত করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

সরকার সারা দেশে ১৬ জেলার ৪৫টি উপজেলায় আট হাজার শিশু যত্নকেন্দ্র তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে ২৫ জন শিশুকে ভর্তি করা হবে। একই সঙ্গে ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার শেখানো হবে। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, শিক্ষা, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা এবং মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে আনতে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বেসরকারি উদ্যোগে দিবাযত্ন কেন্দ্র করে কিছু এলাকায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু কমানোর মতো সাফল্য পাওয়া গেছে।
এ অবস্থায় সরকার মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিশু যত্নকেন্দ্র তৈরির জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০২৪ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শতভাগ বাস্তবায়িত হওয়া কথা রয়েছে। প্রকল্পটির নাম ‘ইন্টিগ্রেটেড কমিউনিটি বেইসড সেন্টার ফর চাইল্ড কেয়ার, প্রটেকশন অ্যান্ড সুইম-সেফ ফ্যাসিলিটিজ’। এর মাধ্যমে সমাজভিত্তিক শিশু যত্নকেন্দ্র স্থাপন ও শিশুদের সাঁতার শেখানোসহ অভিভাবকদের সচেতন করা হবে। ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শিশুর বিকাশ, শিক্ষা ও যত্ন নিশ্চিত হবে। এতে গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ের শিশুরা উপকৃত হবে, সুবিধা পাবে বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ’

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.