বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারীদেরও বিচার হবে – হীরেন পণ্ডিত

পর্ব-৭

0

গত ২০১৯ এর ৩ জুলাই চীন সফরকালে বেইজিংয়ে একটি নাগরিক সংবর্ধনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন যে, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, এবার যারা মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তাদেরও বিচার করা হবে।’ আমরা সবাই জানি এই দাবিটি বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের। শুধু দাবি নয়, প্রত্যাশাও। কারণ, যারা ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তাদের কিছু সদস্যের বিচার হয়েছে, কেউ কেউ দণ্ডপ্রাপ্তও হয়েছে, আর কিছু সদস্য বিদেশে প্রকাশ্যে ও লুকিয়ে আছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে অব্যাহত আছে। কিন্তু সাধারণের মনে একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে- এই কাজটি তো আর ওইদিন ভোর রাতেই হয়নি, এর পেছনে দীর্ঘদিনের একটি পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সে পরিকল্পনার পেছনের ও সামনের মানুষ কারা? ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর আদালতে বিচার কার্যক্রম শেষ হলেও এখনও হত্যার পরিকল্পনাকারীদের বিচার হয়নি।’ এছাড়া বিভিন্ন সময় এই বিষয়টি আলোচনায় আসছে কারা এই ঘটনার পেছনে ছিল, তাদের পরিচয় কি? ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ড সংঘটনকালের তদন্তও বিচারের ফলে সংঘটনকারীদের সম্পর্কে জানা গেলেও এই কাজের মূল হোতারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।

ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে কিছু অনুমাননির্ভর ও কিছু বাস্তব গবেষণা এবং নানা পর্যায়ের অনুসন্ধানের ফলে যেসব তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বা আমাদের কাছে আছে তাতে স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্তে আসা কঠিন নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারীদের একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে আমাদের পূর্বসূরি অনেকের গবেষণা সূত্রজালের আওতায় এসেছে। কিন্তু আমরা নানা কারণে তা স্পষ্ট করে বলছি না বা বলতে পারছি না। ধরুন, যদি আমরা খন্দকার মোশতাকের দিকেই তাকাই আর মনে করি তিনিই সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী (কারণ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদেও দেশপ্রেমিক ঘোষণা করে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন বা হতে পেরেছিলেন) তাহলে ষাটের দশক থেকে বঙ্গবন্ধু ও দলের প্রতি তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে একটি সরল পরিকল্পনাচিত্রও কিন্তু উন্মোচিত হয়।

সে চিত্রপট উন্মোচন করে কেউ কেউ বলছেন মোশতাক আসলে ব্যবহৃত হয়েছিলেন। আমার অনুসন্ধানলব্ধ জ্ঞানের ধারণা মোশতাকের প্রতি এতে সহানুভূতি তৈরি করার একটি চেষ্টা হয়ে যায়, আর তাতে প্রকৃত ও অপর পরিকল্পনাকারীদের আড়ালে থাকার সুবিধা হয়। প্রাথমিক সূত্রে মোশতাকের কর্মজীবন, রাজনৈতিক আদর্শ, চিন্তা ও তৎপরতা নিয়ে আমাদের প্রচুর তথ্য অনুসন্ধান প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ফলে আমার ধারণা ও আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারীদের চেহারা উন্মোচনে মোশতাকের সূত্র ধরে এগুনো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সে পটভূমি তৈরি হয়েছিল ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকায় পাকিস্তানের প্রথম স্বাধীনতা দিবসকে ‘উৎসবের দিন হিসেবে নয়, উৎপীড়নের নিগড় ছিন্ন করার সঙ্কল্প নেয়ার দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিলেন। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু ২৩ বছর দৃঢ়চিত্তে বাংলার মানুষকে নিয়ে স্বাধিকার অর্জনের জন্য সামনে এগিয়ে গেলেন শুধু ওই একটি বক্তব্যেরই মৌলিক লক্ষ্যের দিকে। আমাদের কারোরই বুুঝবার ক্ষমতা এত দুর্বল নয় যে, সেই ‘উৎপীড়নের নিগুড় ছিন্ন করার সঙ্কল্প’-ই এই হত্যাকাণ্ডের মূল পটভূমি।

মোশতাকসহ ব্যক্তিবিশেষ দায়ী পরিকল্পনাকারীদের খুঁজতে আমাদের তাই তখন থেকেই শুরু করতে হবে। দ্বিতীয় সূত্র হলো, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, চিন্তা ও লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম। ১৯৪৮ সালের পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস সামনে রেখে ১২ আগস্ট ‘অধুনালুপ্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলের সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা’ হিসেবে বঙ্গবন্ধু যে বিবৃতি দেন সেখানে আছে তাঁর আদর্শের চূড়ান্ত রূপরেখা। সেই আদর্শের বাস্তবায়ন ছিল তাঁর সারা জীবনের আদর্শ। তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনায় এই আদর্শের বিরুদ্ধবাদীদের সম্পর্ক বা যোগসাজশ ছিল এতে কারও মনে সংশয় থাকা উচিত নয়। সে বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আমরা যে ‘আজাদী’ লাভ করিয়াছি, সেটা যে গণআজাদী নয়, তা’ গত একটি বছরে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। ‘জাতীয় মন্ত্রিসভা’ দীর্ঘ একটি বছরে জনগণের দুইশ’ বছরের পুঞ্জীভূত দুঃখ-দুর্দশা মোচনের কোন চেষ্টা তো করেনই নাই, বরঞ্চ সেই বোঝার উপর অসংখ্য শাকের আঁটি চাপাইয়াছেন। ভুখা, বিবস্ত্র, জরাগ্রস্ত ও শত অভাবের ভারে ন্যুব্জ জনসাধারণের ভাত, কাপড়, ওষুধপত্র ও অন্যান্য নিত্য-ব্যবহার্য্য দ্রব্যের কোন ব্যবস্থা তাঁরা করেন নাই; বরঞ্চ পাট, তামাক, সুপারি ইত্যাদির উপর নয়া ট্যাক্স বসাইয়া ও বিক্রয়-কর বৃদ্ধি করিয়া জনগণের দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ করিয়া তুলিয়াছেন। বিনা খেসারতে জমিদারি বিলোপের ওয়াদা খেলাফ করিয়া তাঁরা জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদিগকে পঞ্চাশ ষাট কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করিতেছেন। নূতন জরিপের নাম করিয়া তাঁরা জমিদারি প্রথার সম্পূর্ণ বিলোপ আট বছর স্থগিত রাখার ষড়যন্ত্র করিতেছেন। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অছিলায় তাঁরা অনেক দেশভক্ত লীগ-কর্মীকেও বিনা বিচারে কয়েদখানায় আটকাইয়া রাখিতেছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মুসলিম ছাত্র সমাজের উপর এবং আরও কতিপয় ক্ষেত্রে জনতার উপর লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার ও গুলি চালনা করিয়া তাঁরা আজাদীকে কলঙ্কিত করিয়াছেন। আজ সেই মন্ত্রিসভাই আজাদী উৎসবের সাময়িক সমারোহের দ্বারা নিজেদের অথর্বতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা ঢাকিবার প্রয়াস পাইতেছেন।

মোশতাক নিজেকে পীরবাড়ির সন্তান পরিচয় রেখে ডান ভাবনার নেতা হিসেবে একটা বাতাস তৈরি করে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। আর তাকে ঘিরে যেসব অসাধু ব্যক্তি ও নেতা আনাগোনা ছিল তাদের দায়ও কিন্তু কম নয়। কারণ, দেখা গেছে ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এদের অনেকেই মোশতাকের কূটচিন্তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিল, যারা ’৭৫ সালের ঘটনাপ্রবাহ, এমনকি এর পরেও নিজেদের অবস্থান বহাল রাখতে সমর্থ হয়েছিল। মহাকালের বিচারে খন্দকার মোশতাক ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বটে; কিন্তু তাকে ঘিরে যাদের পদচারণা ছিল তাদের অনেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বা বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিসিয়ারিদের দলে নাম লেখাতে পেরেছেন। কিন্তু যোগসাজশের দায় যদি তাদের ওপরও পড়ে তাতে আমাদের বিব্রত হওয়া চলবে না। আমাদের জানা আছে যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত হত্যাকান্ডের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় বঙ্গবন্ধু সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের বিতর্কিত সহচর এই খন্দকার মোশতাক আহমদ। মোশতাক বিতর্কিত ছিলেন এই তথ্য ইতিহাস সমর্থিত। কারণ, তিনি দলের মধ্যেই সন্দেহভাজন ছিলেন ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অস্থায়ী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গড়ার প্রশ্নের একজন সক্রিয় উদ্যোগী ছিলেন। যে কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রশ্নে অনমনীয় প্রবাসী সরকার তাকে কিছুটা নজরদারির মধ্যেও রেখেছিল। প্রশ্ন হলো, ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় খন্দকার মোশতাক কি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন, না কি জেগে ছিলেন? নিশ্চয়ই জেগে ছিলেন। কারণ, ঘটনা সংঘটিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই তিনি রেডিও অফিসে যান ও বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।

তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, তিনি নিশ্চয়ই প্রস্তুত ছিলেন। যদি এই প্রস্তুতি তার থেকেই থাকে তাহলে তিনি জানতেন কি ঘটতে যাচ্ছে ও এর পরে তার করণীয় কি হবে। মোশতাক যে সেই পরিকল্পনামাফিক কাজ করেছেন ১৫ আগস্টের দিনভর তার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলেই তা স্পষ্ট হয়। তৃতীয় জিজ্ঞাসা হলো, তাহলে মোশতাক এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা জানতেন। কেন জানতেন? তাহলে তিনি নিশ্চিত ছিলেন ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরে তাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তাহলে এই পরিকল্পনায় মোশতাক কখন থেকে যুক্ত ছিলেন? ১৯৭১ সালের পূর্বোক্ত কনফেডারেশন কানাঘুষায় তার সমর্থন ও প্রবাসী সরকারের নজরদারি ছাড়াও আরও কিছু বিষয় সমানে এসেছে, যাতে মোশতাকের চারপাশে কিছু অসামরিক শক্তি সমর্থনের ছায়া দেখা যাচ্ছে, যা ১৯৭৫ সালের মধ্যে অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনায় মোশতাকের সহায়তাকারী কিছু ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে

এদের এই উদ্যোগই কি কিসিঞ্জারকে কনফেডারেশনের খোরাক যুগিয়েছিল? তাহলে মোশতাকের ও তার সহযোগীদের এসব ভূমিকা বঙ্গবন্ধু কেন আমলে নিতে পারেননি? নিশ্চয়ই পরিকল্পনাকারীদের সেখানেও কোন ভূমিকা ছিল। এছাড়া যারা ১৯৭১ ও পরবর্তীকালে সরকারের আনুকূল্যে ছিলেন, যেমন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী ও কামাল সিদ্দিকী তাদের ভূমিকা বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মিলছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.