প্রত্যাশা ও ব্যথিত হৃদয় – মোঃ গোলাম আসিম বিল্লাহ

0

কোলাহলময় শ্রেণিকক্ষ। শিক্ষকের প্রবেশ ক্ষণমূহূর্তের জন্য চিরায়ত এই কোলাহল ভেঙে দেয় প্রতিদিন । থমকে থাকে কিছুক্ষণ। নির্দেশনামাত্রই হাইবেঞ্চের উপরের বইগুলি খোলা হয়। উৎসুক চেহারাগুলি পরবর্তী নির্দেশনার অপেক্ষায় স্থির হয়ে থাকে। ফসলের মাঠের ধানের চারাগুলি প্রভাতরবির কিরণের প্রতীক্ষায় যেমন স্থির হয়ে থাকে ঠিক যেন তেমন। চারাগুলি সমান থাকে না। উচ্চতার তারতম্য থাকে। রবির কিরণ সে ভারতম্য জানে না। সে সকলের জন্য সমান।

বিষয়ের পর বিষয়ের পাঠ চলে। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ইত্যাদি। পালাক্রমে পাঠ আসে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার। মুকিত, তনু, তাসমিয়া সাদিকা, মাহিদের বইগুলি খোলা হয়, ঠিক তখনই তন্ময়, কৌশিকদের বইগুলিও খোলা হয়। নামাজ-রোজার উপদেশবাণী মুকিত, ঐশীদের কানে পৌঁছে, সাথে সাথেই অদ্বিতীয় কণ্ঠে পূজো-অর্চনার উপদেশবাণী তন্ময়, কৌশিকদের কানে পৌঁছে যায়। সত্যবাদিতা, সদাচারণ পরমতসহিষ্ণুতার বাণীগুলো মুকিত, তাসমিয়া, তন্ময়, কৌশিক সকলের কর্ণকুহরে যুগপৎ ধ্বনিত হয়। পিতার বিচিত্র সন্তান এরা। কেউ পুরুষ, কেউ নারী, কেউ লম্বা, কেউ থাটো কেউ ফর্সা, কেউ কালো, কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম। তবে পিতৃস্নেহ সকলের জন্য সমান ও সমতামণ্ডিত । শুভকামনা স্বার্থহীন ও অসীম ।

এ স্নেহ অতি পুরনো, প্রথমদিকের। যখন ক্লাসে বসে ওদের নাক দিয়ে লোনা নদী প্রবাহিত হত তখনকার । এ স্নেহ লোনা জল মুছে দেয়ার স্নেহ। এ স্নেহ হাতের নখ, দাঁত, চুল, মুখমণ্ডলের প্রতি প্রাত্যহিক দেখভালের স্নেহ । সাদা-কালো, ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলিম বিবেচনাগুলি এ স্নেহকে প্রভাবিত করতে পারে না কখনও । শ্রেণিকক্ষে, বারান্দায়, সিঁড়িতে খেলার মাঠে ফুলবাগানে সর্বঅবস্থানে এই স্নেহের সন্তানগুলি যখন ভেদাভেদহীনভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে তখন পিতৃহৃদয় উৎফুল্ল হয়ে ওঠে । পিতৃহৃদয়ে একতাবদ্ধ সন্তানদের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি ও শান্তির দৃশ্য প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।

ধীরে ধীরে প্রাক ও প্রাথমিক মিলিয়ে ৬ টি বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়মে পুরাতন বিদায় নেয় নতুনের আগমণ ঘটে। পুরাতন-নতুন সেতো প্রকৃতির নিয়ম, পিতৃহৃদয়ের নিয়মতো নয় । পিতৃহৃদযে সন্তানেরা কখনো পুরাতন হয় না। সন্তানদের প্রতি ভবিষ্যৎের প্রত্যাশা থেকেই যায়। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। এই বিভেদ বৈষম্য, অত্যাচার, অনাচারের সমাজের প্রবাহমান হাওয়া

তাদের গায়ে লাগে। এককালের এই সুবোধ ছেলেগুলি একে অন্যের বসতবাড়ি, মসজিদ, মন্দির ভেঙে দেয়। একে অন্যের ধর্মকে অবমাননা করে পিতৃহৃদয়ে তখন হাহাকার ধ্বনি বেজে ওঠে। সন্তানদের প্রতি ভবিষ্যতের প্রত্যাশা মন্দির, মসজিদের বিক্ষিপ্ত টুকরোর সাথে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। পিতৃহৃদয় সেদিন বড়ই ব্যখিত হয়ে ওঠে।

তবে ৬ টি বছর প্রতিপালনের দরুণ এই স্নেহ, মায়া, সম্পর্কের প্রত্যাশার স্খলনে শিক্ষকহৃদয় যদি এতো ব্যথিত হয়, মহাকালের বিবেচনায় যা অতি অল্প সময়, এই জগৎবিধাতা যিনি এই বিশ্বজগতের হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকলকেই অতি স্নেহ-মমতা দিয়ে প্রতিপালন করে চলেছেন অভি আদিকাল থেকে, তাঁর হৃদয় কি ব্যথিত না হয়ে পারে ? (সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে অনুভূত বিঃ দ্রঃ টাইপের ভুল মার্জনীয় ।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.