পদ্মা সেতু : এ কৃতিত্ব কেবলই শেখ হাসিনার । মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

0

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় সেই বিপুল কর্মযজ্ঞ। সবশেষ বিজয়ের মাসে তা পূর্ণতা পেল। আর এসব কারণেই পুরো পদ্মা সেতু দৃশ্যমানের এ কৃতিত্ব একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। এ কৃতিত্বে কেউ অংশীদার হতে পারে না বা প্রশ্নও ওঠে না। কারণ, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ভেতরে ও বাইরে সব বাধা ও প্রতিকূলতাকে জয় করে একক চিন্তা-ভাবনায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়েছিলেন স্বপ্নের সেতু। ২০১৪ সালে নির্মাণযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর পদ্মা সেতুর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যে শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে, তা হলো এই ‘স্বপ্ন’। আরেকটু সুস্পষ্ট করলে বলতে হয়- স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্ন সত্যি হলো। যুক্ত হলো পদ্মার দুই পার। দৃশ্যমান হলো পুরো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু। পদ্মা সেতু সত্যিই একসময় স্বপ্ন ছিল। পরাক্রমশালী বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পর অনেকে ধরেই নিয়েছিল এই সেতু আর হবে না। আশা দিয়েছিলেন একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা। বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘নিজেদের টাকায়ই আমরা পদ্মা সেতু গড়ব।’ স্বল্পোন্নত একটি দেশের রাষ্ট্রনায়ক হয়েও বিদেশি কোনো সাহায্য ছাড়া ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে সেতু নির্মাণের যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, সত্যিই তো সেটা দুঃসাহসিক পদক্ষেপ ছিল। স্বপ্নও বলা যায়। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তা করে দেখালেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্ন আজকের নয়। দুই দশকের বেশি সময় আগের। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তা শুরু হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এরপর ক্ষমতার পালাবদল ও রাজনীতিতে নানা উত্থান-পতন এসেছে। কিন্তু স্বপ্নটা যেন জিইয়ে রেখেছিলেন। আর এ কারণেই ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরেই পুনরায় পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু করেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় সেই বিপুল কর্মযজ্ঞ। সবশেষ বিজয়ের মাসে তা পূর্ণতা পেল। আর এসব কারণেই পুরো পদ্মা সেতু দৃশ্যমানের এ কৃতিত্ব একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। এ কৃতিত্বে কেউ অংশীদার হতে পারে না বা প্রশ্নও ওঠে না। কারণ, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ভেতরে ও বাইরে সব বাধা ও প্রতিকূলতাকে জয় করে একক চিন্তা-ভাবনায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর দেশপ্রেম ও জাতির প্রতি অঙ্গীকারের ফলে আজ তাই স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তব রূপ পেল। কথাগুলো বলার কারণ হলো- একসময় অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো কথিত হোমরা-চোমরা দাবি করতেন যে, ‘আমি নেত্রীকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, এ কারণেই তিনি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ অসার, মিথ্যা, ভিত্তিহীন কৌতুক উদ্দীপক যারা করেন, তাদের প্রতি করুণা ছাড়া কিছু বলার থাকে না। আমরা ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছি এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোবল ও অদম্য সাহসিকতা।

পুরো পদ্মা সেতু অর্থাৎ ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের মূল কাঠামো এখন দৃশ্যমান। এর মাধ্যমে তৈরি হলো রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগের পথ। প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, দ্বিতল এই সেতুর ঢালাইয়ের কাজ, অ্যাপ্রোচ রোড ও ভায়াডাক্ট প্রস্তুত করা ও রেলের জন্য স্ল্যাব বসানো হলেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের উপযোগী হবে। আশা করা যাচ্ছে, এক বছরের মধ্যেই এই সেতুটি চালু করা যাবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রাক্কালেই ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত। মূল সেতু প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আজগুবি দুর্নীতির অভিযোগ এনে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং জাইকা। কিন্তু কেন? কোনো সংস্থা তো তখনো অর্থের ছাড় দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশসহ মর্মাহত হলেন। কিন্তু অদম্য সাহস ও দৃঢ়তায় তিনি প্রকল্পের কাজ নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন করার ঘোষণা দিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তকে সরকারের ভেতরের কতিপয় নীতিনির্ধারক মনেপ্রাণে স্বাগত জানাতে পারেননি। কথিত সুশীল ও একশ্রেণির মিডিয়াও স্বাগত জানানোর পরিবর্তে বিরূপ সমালোচনায় লিপ্ত হয়। তবে দিন শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তাইতো স্বপ্ন আজ পূরণ হলো।

অর্থায়ন বন্ধ করা যে একটি ষড়যন্ত্র ছিল, তা এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাই আমার নজরে আসা এ সম্পর্কিত ঘটনাপ্রবাহের কিছু বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। জাতির স্বার্থে সত্য উদঘাটন ও প্রকাশ করাই সংগত হবে বলে আমি মনে করি। পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ৫টি প্যাকেজ রয়েছে। এগুলো হলো মূল সেতু নির্মাণ, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন এবং নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগ। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত টাকা বরাদ্দ ছিল। মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় এগারোটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। তার মধ্যে বিশ্বব্যাংকের নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসরণপূর্বক মূল্যায়ন শেষে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য ও ৬টি প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য বিবেচনা করে মূল্যায়ন কমিটি তা অনুমোদনের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে প্রেরণ করে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক প্রাথমিকভাবে সম্মতিও দিয়েছিল। এ প্রক্রিয়া চলাকালীন টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী চায়না রেলওয়ের ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ করপোরেশনে বরাত দিয়ে এর স্থানীয় এজেন্ট জনৈক হেলাল উদ্দিন দাবি করেন, তাদের মূল প্রতিষ্ঠানে একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে এবং ওই চিঠিতে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে যোগাযোগ সাপেক্ষে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এ পত্রের একটি কপি বিশ্বব্যাংকের ওয়াশিংটনের প্রধান কার্যালয় ও ঢাকাস্থ কান্ট্রি ডিরেক্টরের কাছে প্রেরণ করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পত্রটি প্রেরণ করে এবং অনুসন্ধানের জন্য অনুরোধ করে। বিশ্বব্যাংকের রেফারেন্স রিপোর্টের একটি কপি দুর্নীতি দমন কমিশনেও প্রেরণ করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধানকালে কথিত চিঠির যথার্থতা যাচাইয়ের জন্য চায়না রেলওয়ের ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ করপোরেশনের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান যে, এ ধরনের পত্র তারা পাননি এবং তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি হেলাল উদ্দিনের কাছেও এ ধরনের কোনো পত্রের কপি প্রেরণ করা হয়নি। পরে উক্ত হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পত্রটি সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

এই হেলাল উদ্দিন পরবর্তী সময়ে আত্মগোপনে চলে যায়। যে পত্রের বরাত দিতে বিশ্বব্যাংক অনুসন্ধানের জন্য অনুরোধ করেছিল, সেই পত্রটি সম্পর্কে সব তথ্য চায়না রেলওয়ের ফিফটিন ব্যুরো গ্রুপ করপোরেশন সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং তারা বিস্ময় প্রকাশ করে। ওই পত্রের কপি পর্যালোচনায় সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে, সৃজিত প্যাডে স্বাক্ষর সুপার ইমপোজ করে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পত্রটি সৃজন করা হয়েছে। প্রথম ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত এখান থেকেই। টেন্ডারে যারা অংশগ্রহণ করেছিল তারা স্পষ্টতই জানায় যে, আমাদের কাছে বাংলাদেশের কোনো কোম্পানি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সাইলেন্ট এজেন্ট নিয়োগের শর্তে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেয়া হয়নি। তারা এও বলেন, প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণী দরপত্রের বিষয়ে তাদের কোনো অনিয়মের অভিযোগ নেই। অভিযোগের সমর্থনে কোনো দালিলিক বা মৌখিক সাক্ষ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় বিশ্বব্যাংকের আনীত প্রথম অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিতর্কিত পত্রখানা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃজনকৃত এবং তা ভুয়া।

উল্লেখ্য, অযোগ্য বিবেচিত অপর একটি প্রতিষ্ঠান ‘চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি’র প্রাক-যোগ্যতা বিবেচনার জন্য তাদের দরপত্র পুনঃপরীক্ষার বিষয়ে দুবার মূল্যায়ন কমিটিকে অনুরোধ করা হয়েছিল। মূল্যায়ন কমিটি তাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে দুবার তাদের সুযোগ দেয়। কিন্তু তারা বারবার ভুল তথ্য ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়ায় বিবেচনায় আসতে পারেনি। অবশেষে তারা প্রাক-যোগ্যতার আবেদন প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু তাদের স্থানীয় এজেন্ট জনৈক ক্যাপ্টেন রেজা সেতু কর্তৃপক্ষকে ভবিষ্যতে খারাপ পরিণতির হুমকি দিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। এ কোম্পানির বিষয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে মূল্যায়ন কমিটির ওপর চাপও সৃষ্টি করা হয়েছিল। কাজেই এটাও একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। এ অনুসন্ধান প্রতিবেদন সম্পর্কেও বিশ্বব্যাংকের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এভাবেই প্রথম অভিযোগের সমাপ্তি ঘটে। অতঃপর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কোনো কোনো পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প ও নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় এবং অনুসন্ধানের জন্য অনুরোধ করা হয়।

পরামর্শক নিয়োগসংক্রান্ত অনুসন্ধান চলাকালে বিশ্বব্যাংক অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের বরাবর পত্র প্রেরণ করলে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে তা জানানো হলে শর্ত সাপেক্ষে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা গ্রহণ করতে দুদক রাজি হয়। দুদকের স্বাধীনতা এবং আইন ও বিধিকে সমন্বিত রেখে দেশ ও জনগণের স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের এ সহায়তা গ্রহণে দুদক রাজি হয়েছিল। পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটি ১৩টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কানাডীয় প্রতিষ্ঠান SNC Lavalin প্রথম থাকায় তাদের কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশ করে; কিন্তু বিশ্বব্যাংক সম্মতি দেয়নি। বিশ্বব্যাংক একটি এক্সপার্ট টিম গঠন করে দুদকে পাঠায়। তাদের সঙ্গে দুদকের একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। প্রাপ্ত তথ্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণ তাদের সামনে উপস্থাপন করা হলে তারা মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করেনি। একপর্যায়ে তারা বলেন, পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি না হলেও ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র’ হয়েছে বলে তাদের বিশ্বাস। তাদের এ দাবির সপক্ষে দালিলিক, মৌখিক এবং ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা সমর্থনের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য চাওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের রেফারেল রিপোর্ট অভিযোগের ভিত্তি হলেও ওই রিপোর্টে বর্ণিত বক্তব্যের সমর্থনে প্রণিধানযোগ্য পর্যাপ্ত সাক্ষ্যের অভাব ছিল। তারা বারবার ভবিষ্যতে সরবরাহ করবে জানালেও শেষ পর্যন্ত তারা সাক্ষ্য-প্রমাণ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়।

বিশ্বব্যাংক মনোনীত মূল্যায়ন কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট ড. দাউদ আহমেদ। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান যে, এ মূল্যায়ন কার্যক্রম চলাকালে বাংলাদেশের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা সরকারি কর্মকর্তা তার সঙ্গে সাক্ষাৎও করেনি বা মূল্যায়ন কাজে কোনো প্রভাবও বিস্তার করেনি। পরামর্শক তদারকির জন্য যে প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বিশ্বব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালার আলোকেই করা হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ অনুসন্ধান চলাকালে পাঁচটি রেসপনসিভ প্রতিষ্ঠানের কাছে অভিযোগের বিষয়ে কোনো তথ্য-প্রমাণ রয়েছে কি না, জানতে চাওয়া হলে তারা মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক বক্তব্য প্রদান করেনি। SNC Lavalin নামীয় প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচিত হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল দাবি করে যে, এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ সাহার কাছে প্রাপ্ত একটি নোটপ্যাডে বর্ণিত তথ্যের আলোকে তারা মনে করে যে, দুর্নীতির অভিপ্রায় ছিল এবং দুর্নীতির জন্য ষড়যন্ত্রও করা হয়েছিল। রমেশ সাহা এবং ইসমাইল নামীয় দুজন কর্মকর্তা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লিপ্ত ছিল বলে তারা দাবি করে। দুদকের অনুসন্ধান টিম এই রমেশ-ইসমাইলের বক্তব্য এবং কথিত নোটপ্যাড বিশ্বব্যাংকের এক্সপার্টের টিমের কাছে চাইলে তারা ‘দিচ্ছি’, ‘দিব’ বলে আশ্বাস দেয়া সত্ত্বেও তা দিতে ব্যর্থ হয়। কথিত নোটপ্যাডের বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিরপেক্ষ সাক্ষী ও সমর্থনযোগ্য দালিলিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কথিত ঘুষের যে পার্সেন্টেজের কথা নোটপ্যাডে লিখিত আছে মর্মে বিশ্বব্যাংক দাবি করলেও সেই নোটপ্যাড দুদককে সরবরাহ করা হয়নি। বিশ্বব্যাংক স্বীকার করে যে, ঘুষ লেনদেন হয়নি, তবে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া যায় যে, রমেশ সাহা লিখিত যে নোটপ্যাডটি তাদের অভিযোগের ভিত্তি, তবে তা একান্তই রমেশের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কে কখন কোথায় কী লিখেছে, তা প্রমাণের দায়িত্ব তার। সে লেখনী দ্বারা অন্যের ওপর দায় বর্তায় না। দুদকের সামনে রমেশও নেই, নোটপ্যাডও নেই; বিশ্বব্যাংক তা সরবরাহ করতে ব্যর্থ। তাহলে ষড়যন্ত্রের ভিত্তি কোথায়? কোনো ভিত্তি ছাড়া তো অনুসন্ধান কার্যক্রম চলতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল দুদকের অনুসন্ধান টিমের যুক্তি মানলেও শেষ পরিণতিতে তাদের একটি দাবি, দুর্নীতি না হলেও ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘সালিস মানি, তবে তালগাছ আমার’। এ ক্ষেত্রে এটাই বলতে হয়।

কানাডার অন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিসে এরূপ অভিযোগে একটি বিচার চলছিল। দুদকের পক্ষে তৎকালীন দুদকের মুখ্য আইন উপদেষ্টা (বর্তমানে মাননীয় আইনমন্ত্রী) আনিসুল হককে উক্ত কোর্ট থেকে তথ্য আনার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনিও যথারীতি কানাডা গিয়ে কোর্ট থেকে তথ্য আনার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু আদালত থেকে আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ সরবরাহ করা হয়নি। তবে তিনি কোর্ট থেকে যে সাক্ষ্যের প্রসিডিং প্রাপ্ত হয়েছিলেন তা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করলে দুর্নীতি বা দুর্নীতির ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অবশেষে ৪-৯-২০১৪ তারিখে দুর্নীতির জন্য ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্তকালীন দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত ঋণ-সহায়তা পাওয়ার স্বার্থে কোনো কোনো মহল থেকে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দুদককে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করতে পরোক্ষ ইঙ্গিত দেয়া হলেও দুদক বিবেকের তাড়নায় সত্য ঘটনা প্রকাশের দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হয়নি। অহেতুক সমালোচিত হয়েছি, কিন্তু বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দিইনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গোয়েবলসীয় কায়দায় পদ্মা সেতু নিয়ে অপপ্রচার হয়েছে। একটি মিথ্যাকে বারংবার বললে সেটি সত্যের মতো শোনায়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও বারবার বলা হয়েছে- দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জনগণের মগজে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এ অপপ্রচার চালিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে যে, এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একাধিক ব্যক্তি জড়িত। অবশেষে দুদকের তদন্তে এসব অপপ্রচার ভিত্তিহীন হিসেবে প্রমাণিত হয়। পরবর্তী সময়ে কানাডার অন্টারিও কোর্ট অব জাস্টিসের বিচারের রায়ে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, এ অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং চায়ের কাপে ঝড় তোলার সমান। নেহাত একটি গালগপ্প।
আজ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দৃঢ়প্রত্যয়ী সাহসী দেশপ্রেমিক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা ব্যতীত সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু দৃশ্যমান করলেন। তাই আবারও দৃঢ়ভাবে বলতে হয়, এ অর্জন ও কৃতিত্ব একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার এবং এ কৃতিত্বের কেউ ভাগীদার নয়।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.