বৈষম্য ও মার্গ । ড.মাহবুব হাসান । নিউ ইয়র্ক

0
আমাদের এই ধরণীর যে কতো রূপ, তা জানতে চাইলে কেবল মানুষের মন পাঠ করতে পারলেই চলে। কিন্তু মুশকিল হলো মন পাঠের কোনো দীক্ষা নেই আমার। আমার নেই কোনো মনোবিজ্ঞানির প্রশিক্ষণ। ফলে মন নিয়ে কি কারবার চলে তা জানি না। সমাজ বিজ্ঞানিরা যা জানেন, তার সিকিও জানি না আমি। কিন্তু সেজে আছি মহাজ্ঞানী। শুধু এ-টুকু জানি যে আমি জানি না কিছুই। আর যা কিছু প্রদর্শনযোগ্য তা তো পাঠকের সামনে দিয়েছি। কিন্তু পাঠক বাবাজি’রা তা না পড়ে তারা সস চাটে, সসি লেখা পাঠে মগ্ন। তাতে খুব সহজেই সে সবের ভেতর মহলের গল্প জানা যায়। দুনিয়াটা কী এ-রকম?
বহুকাল ধরে ভেতরে ভেতরে বৈষম্য বা ডিসক্রিমিনেশন শব্দটিকে লালন করছিলাম। এখনো তা করি। কেন করি? কারণ আমি সেই যুবক বয়স থেকেই অনুভব করে আসছি কতোভাবেই না এই বৈষম্য চলে। মায়ের হাতে থেকে যখন পাতে মাছের মাথা না পেয়ে বা মুরগির রান না পেয়ে কতোবার যে মর্মদহনে মরেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আবার ঈর্ষাও করেছি ভাইদের যারা ওই মহামূল্যবান রান বা মাছের মাথাটা পাতে পেয়েছে। আমি যে ঘুরে ফিরে পাইনি তা নয়, পেয়েছি এবং ভোগও করেছি। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে নিজেকে বষ্ণিত ভেবেছি।  সেটাই ছিলো সূচনাকাল বৈষম্যের। আব্বার ব্যাপারেও প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতা আমার।
আমি গ্রামের স্কুলেই পড়েছি এএসসি পর্যন্ত। কিন্তু তখনও আমাদের বাসা টাঙ্গাইল শহরে। আমাকে শহরের স্কুলে ভর্তির কোনো চেষ্টাই করা হয়নি। তখনও সেটা সেভাবে বুঝিনি। পরে যখন বুঝলাম, তখন দেরি হয়ে গেছে। বৈষম্য শব্দটি পেলাম রাজনীতিতে সক্রিয় ও রাজনৈতিক পাঠের পর। বামচেতনার পথ ধরে জানলাম বৈষম্য কারে কয়। পাকিস্তানি শাসকরা যে আমাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, আমাদের সম্পদ লুটে নিয়ে ইসলামাবাদ মহানগর গড়ে তুলেছে, তখন বুঝলাম বৈষম্য কেমন। আমি ৭০ সালেই ঢাকা কলেজে পড়ার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু সেটা হয়নি। আর্থিক সঙ্কটের কথা বলে রোধ করা হয়েছিলো। আমাকে কক্সবাজারে পড়ার কথা বলা হয়েছিলো। কিন্তু সেখানে আমার
টিউশন ফি দিতে না হলেও সেটাও তো মফস্বলই। টাঙ্গাইলের মওলানা মোহম্মদ আলী কলেজেই আমি বেশ ভালো বোধ করলাম। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সা’দত কলেজে পড়ার কথা বলা হয়েছিলো, কিন্তু আমি আর কারো কথা শুনিনি। আমি চলে এলাম ঢাকা কলেজে।
বৈষম্যের পারিবারিক পাঠ চুকালেও আরেক ধরনের বৈষম্যের মধ্যে পড়লাম। আমাকে বহুবারই বলা হয়েছে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে, কিন্তু আমি আর রাজনৈতিক বৈষম্যের নিগড়ে মাথা পেতে দিতে রাজি হইনি। তাই বলে যে সামাজিক বৈষম্য বা প্রতিবেশ বৈষম্যের অবসান হয়েছিলো তা কিন্তু নয়। বরং আমি সেগুলো হাড়ের মধ্যে অনুভব করেছি, উপলব্ধি করেছি। আমার চারপাশের আমার প্রজন্মের সাংস্কৃতিক চিন্তার ভেতরেও তারা আছে, ঘাপটি মেরে, যা সহজে কেউ বুঝতে পারে না। আমি বুঝি। কারণ সে সবের আমি ভোক্তা।
যারা নৃতত্ত্ব যাকে আমরা এনথ্রোপলজি হিসেবে চিনি বা জানি, পড়ছেন, তারা জানেন, মানুষকে নানা শ্রেণিতে ভাগ করে নিয়ে কোন সাংস্কৃতিক আধার তারা নির্মাণ করেছেন, তা বোধগম্য নয়। তবে এর পেছনে যে নির্মাতাদের রাজনৈতিকও সাংস্কৃতিক অভিসন্ধি ছিলো আজ তা আমরা বুঝি।। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই বিভক্তির অন্তর্নিহিত কারণ জানে না। গায়ের রং, মাথার আকার , চুলের প্রকারভেদ, ঠোঁটের রূপের পার্থক্য, চোখের গঠন, চোখের মণির গঠন ও রং, নীল-সবুজ, ক্যাটস আই বা বেড়াল চোখ ইত্যাদি অনুপুঙ্ক্ষ বিষয় বর্ণনা করে তারা যে মানুষকে বর্ণবাদের ফাঁদে ফেললেন, আজ তাই পৃথিবীর শাদা মানুষের শেষ্ঠত্বের দাবি করার কারণ। এই নিয়ে শাদা রঙের মানুষের হাতে হত্যার শিকার
কম হয়নি কালো বাদামি বা পীতাঙ্গরা। ‘মানুষ’কে এই বর্ণবাদের পাটাতনে নিয়ে আসার অপরাধে যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা নেই। কারণ, সেটা রাজনৈতিক স্বার্থের মতোই বর্ণবাদি স্বার্থ কাজ করে। তারপরও দুই চারজন নৃতাত্ত্বিক গবেষণা করে বলেছেন যে মানুষ এই পৃথিবীতে এসেছে কালো রঙের হয়েই। অর্থাৎ কালো রঙের মানুষেরাই ‘আদি’ মানুষ। তারা যে-ভাবেই এই ভূমন্ডলে আসুক না কেন, এখানে আসার সময় তারা কালো রঙেরই ছিলো। মাত্র ২৪ হাজার বছরে তারা প্রথমে ফ্যাকাশে এবং পরে শাদা ও রক্তাভ বা ফ্লেসি হয়ে ওঠে, যারা খাদ্যান্বেষণে আফ্রিকা থেকে ইউরোপের দিকে গিয়েছিলো। অতএব শাদারা মানুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এটা মনে করা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক হিংস্রতারই নমুনা। আর এই নমুনার সুতো ধরেই তারা আজো, এই আমেরিকান সমাজে বৈষম্য করে চলেছে।
শুধু এটাই নয়, আপনি যদি তাদের চিহিৃত ‘লিস্ট ডেভেলপ’ কান্ট্রির লোক হন, আপনারা পাত পাবেন না তাদের রচিত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দাওয়াতে। যতক্ষণ পরযন্ত তাদের তোষামোদকারী না হবেন, ততক্ষণ পযর্ন্ত ‘এলিয়েন’ হিসেবেই থাকতে হবে । আর প্রতিভার কথা যদি তোলেন, তাহলে তার ফেক রুপ আমরা বুঝি। আমার বা আমাদের বিবেচনায় ইউরোপের বা আমেরিকার যারা তৃতীয়শ্রেণির সৃষ্টিশীল তাদেরই আদর-সোহাগ বেশি। কারণ তারা তাদেরই সন্তান। তাদেরই ভাষিক সহোদর। এদের বাইরেও যে পৃথিবী আছে, তাদের সাহিত্যও যে এদের চেয়ে ভালো বা কোনো অংশেই কম নয়, তা বুঝতে হলে, নিজেদের চিন্তার প্যাটার্ন পাল্টে বাকি বিশ্বের সাহিত্য দেখতে হবে। অথবা প্রত্যেক জাতিসত্তার নিজস্ব জগতের নিজস্বতা যে আছে, তাকে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু গোটা ইউরোপ ও আমেরিকা হচ্ছে‘ নার্সিসাস’। নিজের রুপ ছাড়া অন্য কিছুই চেনে না, জানে না। সে সব পাঠেরও কোনো উদ্যোগ নেই তাদের ভেতরে। তারা যে অন্ধ এবং সেই অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে মরে যাচ্ছে এটাও তারা অনুভব করে না। অর্থাৎ নিজস্ব মার্গে বসে আছে। এই মা্র্গ থেকে তাদের নামতে হবে দুনিয়ার অন্য অংশের সাথে পাশপাশি দাঁড়াতে হবে। এ-ছাড়া মুক্তি নেই, বৈষম্যেরও অবসান নেই, হবে না।
০৮/২২/২০২০
নিউ ইয়র্ক ।
জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানের আগে কেউ একজন এ-ছবিটি তুলেছিলেন। শামসুর রাহমানর ওপর আমার একটি বই আছে। নাম উত্তর-ঔপনিবেশিক কবি।
আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.