মায়াজালে এখনো আমি । আনান্নিয়া আন্নি

0

                                                                                   পর্বঃ ১৩
(৭ নভেম্বর)
বড় ভাবির ডাকে ঘুম ভাঙলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সকাল ন’টা বাজে। এতো বেলা হয়েছে আর আমি কিছুই টের পাইনি। গতরাতে নীড় এর সাথে কথা বলতে গিয়ে অনেক রাত করে ঘুমিয়েছিলাম বলে বোধহয় কিছুই বুঝতে পারিনি। একদিন আগে রিলিজ হওয়ায় নীড় কাল রাতেই ফোন কিনে সবার আগে আমাকে মেসেজ করেছিলো, ছেলেটা বড্ড খুশি আমার সাথে কথা বলে, সত্যি বলতে কি আমারও আজ অনেক খুশি লাগছে, কেনো লাগছে কতটা লাগছে সেসব আমি জানিনা, শুধু আমার ভেতরে আমি একটা মানসিক শান্তি অনুভব করতে পারছি।

আজ সারাদিনে নীড় এর সাথে কথা বলেছি তেতাল্লিশ মিনিট একুশ সেকেন্ড। এখন রাত ১ টা বেজে ১২ মিনিট। আমার সকালের কথা যার সাথে শুরু হয়েছিলো, রাতেও তার সাথে কথা শেষ করে ঘুমোতে যাচ্ছি আমি।

সবকিছু তো এমন সুন্দর থাকতে পারতো রে ঝিলি। কেনো যে সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো?

কেনো সবটা এলোমেলো হয়েছে তার থেকে বড় কথা হলো কিভাবে সবটা এলোমেলো হয়েছে? এতো সুন্দর সম্পর্কের শুরু টা, কিভাবে শেষ হলো আর সেই আগের মানুষ টাই বা কি করে তাদের মধ্যে প্রবেশ করলো সেটা জানাটাই এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চল আমরা পুরোটা শেষ করি…

এরইমধ্যে দরজায় বেল বাজতে শুরু করলো। বোধহয় ছোট কাকি চলে এসেছে। কুমু গিয়ে দরজা খুলে দিলো,পেছন পেছন ঝিলি ও গিয়ে দাঁড়ালো। ছোট কাকি কে নিয়ে ছোট কাকা এসেছে, দুপুরের খাবার নিয়ে বোধহয় আবার যাবে।

ছোট কাকা আর কাকির মুখ দেখে কেমন অন্যরকম লাগছে। কিছু খারাপ সংবাদ হবেনা তো?

ছোট কাকি… কি বলেছে ডক্টর? কি হয়েছে ছোট ফুপু-র?

ছোট কাকি কোনো কথা-র উত্তর দিলোনা, গায়ের শাল টা খুলে হাতের টিভিন বক্স টা রাখতে রাখতে বললো,,,
কুমু.. মা ভাতের চাল টা একটু ধুয়ে বসিয়ে দিবি? আমি চট করে আসছি। তোর ছোট কাকা আবার দুপুরের খাবার নিয়ে হসপিটাল যাবে তো।

সে নাহয় আমি ভাত বসিয়ে দিচ্ছি ছোট কাকি কিন্তু ছোট ফুপু-র কি হয়েছে সেটা আগে বলবে তো?

ডক্টর বলেছে তোর ছোট ফুপু আর কখনও আগের মতো স্বাভাবিক হবেনা। আগের মতো করে কথা বলতে পারবেনা কখনও। আপাতত কতদিনের জন্য চিকিৎসা চলবে তাও ঠিক করে বলেনি ডক্টর রা। তবে শহরের ভালো কোনো হসপিটালে অ্যাডমিট করিয়ে ভালো চিকিৎসা দিতে পারলে কিছু ভালো হলেও হতে পারে।

কিন্তু কেনো এমন হয়েছে সেটা নিয়ে কিছু বলেনি ডক্টর রা??

কুমু-র প্রশ্ন শুনে ছোটো কাকি কেমন বিরক্তি-র চোখে তাকালো৷ কিছু বলার আগেই ঝিলি এক গ্লাস পানি নিয়ে ছোট কাকি-র হাতে দিয়ে বললো;
ছোট মামি.. পানি টা খেয়ে তুমি এসো, আমি আর কুমু ভাত বসিয়ে তোমায় সাহায্য করে দিচ্ছি।
চল কুমু।কুমু-র হাত ধরে টানতে টানতে ঝিলি রান্নাঘরে চলে গেলো।
কুমু… বড্ড বেশি বকবক করিস তুই। দেখছিস তো ছোট মামা মামির মন মেজাজ ভালো নেই তারপর ও প্রশ্ন করেই চলেছিস।

ছোট কাকি রান্নাঘরে এসে কুমু আর ঝিলি কে অল্প কিছু কাজ ভাগ করে দিয়ে বাকি রান্না গুলো সেরে নিলো। এই এতোটা সময়ে ছোট কাকি আর কোনো কথা বলেনি। বোধহয় ছোট কাকির মন আজ একটু বেশিই খারাপ।দুপুরের রান্না শেষ করে, টিফিন কেরিয়ারে খাবার গুছিয়ে ছোট কাকি বললো;

কুমু.. তোর ছোট কাকা কে একটু ডেকে দিবি মা। কাল সারারাত ঘুমায়নি বোধহয় ঘুমিয়ে পরেছে।হসপিটালে খাবার নিয়ে যেতে হবে তো। আর তোরা চাইলে এখন ছোট কাকার সাথে একবার গিয়ে ছোট ফুপু কে দেখে আসতে পারিস। ওদিকে তোর মা আর বড় ফুপু কাল রাতে ঘুমায়নি, তোরা সন্ধে অব্ধি থাকলে ওরা এসে একটু বিশ্রাম করে যেতে পারতো। আমাকে তো আবার রাতের রান্না করতে হবে।

কুমু গিয়ে ছোট কাকা কে ডেকে দিলো, ছোট কাকি জোর করায় চটজলদি খেয়ে তৈরি হয়ে নিলো কুমু আর ঝিলি। ছোট কাকার খাওয়া হলে তিনজন মিলে বেড়িয়ে পরলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

হসপিটাল পৌঁছে সবার সঙ্গে দেখা হলো। ওই তো ছোট ফুপু শুয়ে আছে , মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতে সুচ বেঁধানো, স্যালাইন চলছে। নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে সেই সুন্দর স্বাভাবিক মানুষ টা আজ পরাজিত। আজ তার কথা বলার ক্ষমতা টুকুও আর নেই, ক্ষমতা বললে ভুল হবে, বোধহয় ইচ্ছে শক্তির পরিসমাপ্তি বলা চলে এটাকে।

ছোট কাকা-র সাথে কুমু আর ঝিলি কে রেখে মা, বড় ফুপু আর মেজো কাকা বাড়ি চলে গেলো। সন্ধেবেলা বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় হসপিটাল হয়ে কুমু আর ঝিলি কে নিয়ে বাড়ি ফিরবে।

সবাই চলে গিয়েছে, ছোট ফুপু-র বেডে-র পাশে টুল নিয়ে বসে আছে কুমু আর ঝিলি। আর পাশের খালি বেডে ছোট কাকা বসে ঝিমচ্ছে। কুমু আর ঝিলি ফুপু-র পাশে বসে ফিসফিস করে কিসব বলছে, বোধহয় ওদের সিক্রেট কথা হবে। একটু বাদে কুমু গিয়ে ছোট কাকার গায়ে আলতো করে হাত রেখে ছোট্র করে এক ডাক দিয়ে বললো;
ছোট কাকা… এখানে বসে বসে ঝিমচ্ছ যে, বাইরে গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে আসলেই তো পারো, তাহলে চাঙা লাগতো। আর নাহলে এই বেডে শুয়ে ভালো করে ঘুমিয়ে নাও। আমি আর ঝিলি তো আছিই।

না রে এখন আর ঘুমোবোনা, বিকেল হয়ে গিয়েছে প্রায়, তোরা বরং বসে থাক ফুপু-র কাছে আমি চা খেয়ে একটু ঘুরাঘুরি করে আসি।

আচ্ছা শোনো আসার সময় আমার জন্য ও এক কাপ চা এনো কিন্তু, ঝিলি তো চা খায়না।

আচ্ছা নিয়াসবো। তোরা গল্প কর আর কোনো দরকার হলে পাশের রুমে নার্স রা বসে আছে ওদের ডাকবি কেমন।
এই বলে ছোট কাকা বেরিয়ে গেলো। কুমু এবার ঝিলির দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিয়ে বললো….. একটা জিনিস দেখবি?

কি??

কুমু এবার নিজের ব্যাগ থেকে ডায়েরি টা বের করে ঝিলি কে দেখিয়ে বললো,ভালো করিনি বল?

না একদম ভালো করিসনি তুই। এখানেও তুই ডায়েরি টা এনেছিস, কে বলেছিলো এতো রিস্ক নিতে? যদি কেউ দেখে নেয় আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে ছোট খালার ডায়েরি টা পড়ছি তাহলে কি বাজে ব্যাপার হবে ভেবেছিস একবার?

আরে এতো চাপ নিচ্ছিস কেনো তুই? আমরা ওই খালি বেড টাতে বসে বসে পড়বো আর পাশের জানালা দিয়ে তুই মাঝে মাঝে দেখবি ছোট কাকা গেইটে ঢুকছে কিনা ব্যাস আর কোনো চিন্তা নেই। ডায়েরি টা এনেছিলাম সুযোগ পেলে পড়বো বলে, নাহলে কি করে এতোটা সময় কাটবে আমাদের বলতো?

তা বেশ ভালোই করেছিস। চল পড়তে শুরু করি…

(৮ন নভেম্বর)

ইমাদ এর সাথে সম্পর্কের পর আমি পুরো একটা অন্য জগতে বিচরণ করছিলাম যেখানে ছিলো ধরা বাধা নিয়ম,ছিলো অনেক সীমাবদ্ধতা, আর ছিলো আমার ওপর কারো চাপিয়ে দেয়া অহরহ মতামতের সাম্রাজ্য। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছি, সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি কিন্তু আমি পুনরায় কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাইনি। আমি একদম একা থাকতে চেয়েছি কিন্তু তারপর ও বোধহয় আমি নীড় এর সাথে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছি। আমি চাইলেও নীড় কে এড়িয়ে চলতে পারছিনা। আমি নীড় এর কাছে কেমন একটা মানসিক শান্তি,একটা মানসিক তৃপ্তি অনুভব করতে পারছি যেটা থেকে আমি বহুদিন অনেক দুরে ছিলাম। অনেক গুলো দিন আমি মানসিক অশান্তিতে ভুগেছি, যাতে করে আমি আমার আমি কে ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু এখন আমার সাথে যা হচ্ছে যা হতে চলেছে তার সবটাই তো ছিলো পূর্ব নির্ধারিত, সবটাই হয়তো ওপরওয়ালা চেয়েছেন বলেই হচ্ছে, তাই আজকের পর থেকে আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ নয়,স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে কোনো অতীতের পুনরাবৃত্তি হতে দেবোনা আর।
জীবনকে চলতে দেবো জীবনের মতো করে…

চলব❤️

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.