খাদ্য মজুতে নজর

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : সম্ভাব্য বৈশ্বিক খাদ্যসংকট এড়াতে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ। প্রস্তুতি হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্যের মজুত বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ১০ লাখ টন চাল-গম আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সরকারিভাবে আনা হচ্ছে আরও পাঁচ লাখ টন চাল। বেসরকারিভাবে ১৪ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সব মিলে ২৯ লাখ টন চাল-গম আমদানির উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। আরও নতুন উৎস খোঁজা হচ্ছে। সুবিধামতো হলে আমদানি করা হবে আরও খাদ্যশস্য। এই উদ্যোগের ফলে আপতত খাদ্যের কোনো সংকট হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে না।

আগামী বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের খাদ্য বিভাগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে বিশ্বের অনেক দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশও এই ঝুঁকিতে রয়েছে। সকলকে মিতব্যায়ী হতে এবং সর্তক থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। সতর্কতার অংশ হিসেবেই খাদ্য আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকার মনে করে, ঘরে পর্যাপ্ত খাদ্য থাকলে বিশ^ অর্থনৈতিক বিপর্যয়েও বাংলাদেশে তেমন কোনো ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হবে না। আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদন চাহিদার খুব কাছাকাছি। অল্প কিছু খাদ্য আমদানি করে মজুত রাখতে পারলে আর কোনো শঙ্কাই থাকবে না।
যে সব কারণে বিশ^ব্যপী দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে এর মধ্যে রয়েছে- রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধ, প্রাকৃতিক কারণে বিভিন্ন দেশে পর্যাপ্ত ফলন না হওয়া, অবরোধের কারণে খাদ্যের অবাধ প্রবাহ বিঘিœত হওয়া ইত্যাদি। ইউক্রেনে প্রচুর খাদ্য শস্য উৎপাদন হয়। দেশটিকে ইউরোপের রুটির ঝুঁড়িও বলা হয়। যুদ্ধের কারণে সেখানে ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া পাকিস্তানে বন্যায় এবার ব্যাপক ফসলের ঘাটতি হয়েছে। আফ্রিকা, ইউরোপজুড়ে খরায় ফসলহানি ঘটেছে।

অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারতসহ বিশে^র আরও অনেক দেশে এবার আশানুরূপ ফলন হয়নি। সব মিলে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন এবার অনেক কম হয়েছে। সারাবিশ্বে ইতোমধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামী বছর এর প্রভাব আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যে কারণে অনেক দেশে খাদ্য ঘাটতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে আমরা খাদ্য আমদানির ওপর জোর দিয়েছি। ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে। সরকারিভাবে আরও পাঁচ লাখ টন চাল কেনা হবে।  বেসরকারিভাবে চাল আমদানি অব্যাহত থাকবে। প্রাধানমন্ত্রী বেসরকারিভাবে চাল আমদানির মেয়াদ ডিসেম্বর থেকে বাড়িয়ে মার্চ পর্যন্ত করেছেন।

খাদ্যমন্ত্রী বলেন, রাশিয়া থেকে পাঁচ লাখ টন গম আমাদানি করা হচ্ছে। এর মধ্যে দুই লাখ টন ইতোমধ্যে দেশে এসে পৌঁছেছে। বুলগেরিয়া, আর্জেন্টিনা থেকে বেসরকারিভাবে দেড় লাখ টন গম আমদানি প্রকিয়াধীন রয়েছে। আমাদের খাদ্যের কোনো সমস্যা তো হবে না। সবকিছু ঠিক থাকলে এবং আগামী বোরো ফলন ভালো হলে আমরাই বরং চাল রপ্তানি করতে পারব বলে আশা করি। মন্ত্রী বলেন, বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টিমূলক পদক্ষেপের কারণে আমরা নিরাপদ অবস্থানে আছি।

খাদ্য বিভাগের একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে এবার আমন ফলন মোটামুটি ভালো হয়েছে। প্রথম দিকে অনাবৃষ্টির কারণে ফসলহানির যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, সরকারি তৎপরতায় সেচ দিয়ে তা অনেকটা পুষিয়ে গেছে। শেষদিকে বৃষ্টিতে ফসল ভালো হয়েছে। পাশাপাশি এবার নিচু এলাকায় যেখানে আমন ফলে না, এমন অনেক স্থানে আমনের ভালো ফলন হয়েছে। কৃষকরা ঝুঁকি নিয়ে সেখানে আমন লাগিয়েছে।

আর কোনো প্রকৃতিক দুর্যোগ না হলে আমনের ফলন ভালো হবে। লক্ষ্য পূরণ না হলেও কাছাকাছি থাকবে। এখন সরকার তাকিয়ে আছে আগামী বোরো ফলনের দিকে। বোরোর ফলন ভালো হলে বাংলাদেশে বিশ^ খাদ্য সংটের তেমন প্রভাব পড়বে না। বোরো ফলন যাতে ভালো হয়, সে লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে পর্যাপ্ত সার আমদানি করে রেখেছে। দেশের সারের কোনো সংকট নেই।
এর পরও খাদ্য নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না সরকার। যে কারণে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্য শস্য আমাদনির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। সরকারি উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টরা মনে করেন বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতিতে আগামী বছর হয়তো টাকা দিয়েও খাদ্য আমদানি সম্ভব হবে না। যে কারণে আগেভাগে খাদ্য আমদানি করে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার খাদ্যশস্য আমাদনির পাশাপাশি আগামী বোরো ফলনের ওপর জোর দিয়েছে।  

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি খাদ্যশস্যের মজুত প্রায় ১৬ লাখ টন। এর মধ্যে আবার শুরু হচ্ছে আমন সংগ্রহ কর্মসূচি। বেসরকারিভাবে ইতোমধ্যে ১৪ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ আমদানি প্রক্রিয়া আগামী মার্চ পর্যন্ত চলবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সংগ্রহ ও সরবরাহ অনুবিভাগ) মো. মজিবর রহমান বলেন, সাধারণত ভিয়েতনাম, ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে চাল আমদানি করা হয়। কম্বোডিয়া থেকে আনার বিষয়টিও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এর বাইরে অন্যান্য জায়গা থেকেও চাল-গম আনার চেষ্টা রয়েছে। নতুন নতুন উৎসের সন্ধান করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, চাল-গম পাওয়া গেলেও আমাদেরকে মূল্যের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয়। পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চাহিদার সঙ্গে জোগান সমন্বয় করাই হচ্ছে আমাদের মূল কাজ। বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য আমরা এরই মধ্যে ১৪ লাখ টনের মতো অনুমতি দিয়েছি। সেখানেও চাল আসছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত  সেখানে চাল আসার কথা।

পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনে সময় বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। আমাদের এখন পর্যন্ত মজুত ভালো। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চলমান থাকায় মজুতের একটা অংশ চলে যাবে। এ ছাড়া ওএমএসও চলছে। আমরা চাল আনছি, আবার বিতরণও হচ্ছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অপর এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের এখন খাদ্যশস্য মজুতের সক্ষমতা ২০ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে এখন গুদামগুলোতে পৌনে ১৬ লাখ টনের মতো ধান-গম রয়েছে। গুদামে খুব বেশি জায়গা নেই। তাই সরকার চাইলেই ইচ্ছামতো খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে পারছে না। সকল দিক বিবেচনায়র রেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার চাল আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে।

গত ২৩ জুন চালের আমদানি শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চালের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য করা হয়েছে। পাশাপাশি ২৫ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে নিয়ন্ত্রক শুল্ক। ফলে চাল আমদানিতে মোট করভার ৬২ শতাংশ থেকে কমে নেমেছে ২৫ শতাংশে। নতুন শুল্ক ছাড়ের মেয়াদ ছিল গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। এই শুল্ক ছাড়ের অনুমোদন পেতে আমদানিকারকদের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার শর্ত জুড়ে দেয় এনবিআর।

পরে ২৮ আগস্ট চাল আমদানিদে আরও ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমানো হয়। এখন চাল আমদানির  ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে ১৫ শতাংশের কিছু বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আমদানিকারকরা পাঁচ শতাংশ অগ্রিম কর ও পাঁচ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং মাত্র পাঁচ শতাংশ নিয়ন্ত্রক শুল্ক পরিশোধ করেই চাল আনতে পারছেন। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সুবিধায় চাল আমদানি করা যাবে।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.