পদ্মার বুকে বালু ও মাটি দস্যুদের তান্ডব
নিজস্ব প্রতিনিধি : পাবনা জেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মার বুকে হানা দিয়েছে বালু ও মাটি দস্যু। তৈরী করেছে মাঝ নদী পর্যন্ত রাস্থা। গড়ে তুলেছে ইট ভাটা। চলছে এসকাভেটর সহ ভাড়ী যান। বুক চিড়ে তোলা হচ্ছে বালু পাড় কেটে মাটি। তীর থেকে মধ্য পদ্মা পর্যন্ত জেগে ওঠা চর এখন তাদের দখলে। এ যেন বালু ও মাটি দস্যুদের অভৈয় অরণ্য। হঠাৎ দেখলে মনে হবে জনস্বার্থে বড় কোনও প্রকল্পের কাজ চলছে। কিন্ত না এটা পদ্মা নদীর বালু ও মাটি লুটের মহা আয়োজন। আয়োজকরা ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় দিয়ে চালাচ্ছে মহা-যজ্ঞ। পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের দিয়ার রূপপুর এবং লক্ষ্মীকুন্ডা গ্রামের চিত্র এগুলো। অথচ মাত্র কয়েক মিটারের মধ্যে চলচ্ছে সরকারের নির্মানাধীন মেগা প্রকল্প রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ। রয়েছে বসতি স্থাপনা আর ফসলি জমি। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে পদ্মানদীর স্বাভাবিক প্রবাহ। তাছাড়া ধূলা বালিতে আশ-পাশের পরিবেশ হচ্ছে দুষিত।
প্রশাসনের তথ্য মতে, ঈশ্বরদী উপজেলায় কোনও বালুমহাল নেই। তবে বছরজুড়েই এ উপজেলার পদ্মানদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রির চলে মহোৎসব। অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অবাধে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ফলে সৃষ্ট নদীভাঙনে অনেক পরিবার বাস্তহারা। অবৈধ এই সকল কাজ বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। ক্ষেত্র বিশেষে দায়সারা কিছু অভিযান পরিচালিত হলেও নদী অববাহিকায় বালু লুটের চিত্র অপরিবর্তিতই থাকে।
উপজেলার দিয়ার রূপপুর গ্রামের মৎস্যজীবী আজিজুল আলম অভিযোগ করেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিন্টু, ১০-১২ জন ড্রাম ট্রাক মালিক নিজেদের অর্থ ব্যয় করে পদ্মা নদীর ওপর সড়ক নির্মাণ করেছেন। তাদের আসল উদ্দেশ্য নদীর বালু উত্তোলন করে ওই পথে পরিবহন করা।’ কৃষক নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘গত বছরও একই কায়দায় পদ্মানদীর ওই স্থানে সড়ক নির্মাণ করে অবৈধ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন ও বিক্রি করেছে তারা। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে জানালেও কোনও প্রতিকার মেলেনি।’
দিয়ার রূপপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করে বালু পরিবহন করার জন্য সড়ক নির্মাণ হয়েছে। এটি দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় ৩০-৩৫টির মতো বালুর ট্রাক-ট্রাক্টর ও ড্রাম ট্রাক চলাচল করে। আর এই বালুর গাড়ী চলাচল করায়, রূপপুর মোড়ের তিন বটতলা, দিয়াড় বাঘইল, চররূপপুর, নতুন রূপপুর, বিবিসি বাজার, সারেংপাড়া, নলগাড়ি, ফুটু মার্কেট, নুরুল্লাপুরসহ লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন স্থান ভেঙে ছোট-বড় গর্ত ও খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। আর এইা সড়কে ট্রাক চলাচলের সময় ধুলাবালিতে একাকার পরিবেশ হচ্ছে দূষিত। সাধারন মানুষের নাভিস্বাস অবস্থা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লালন শাহ সেতু ভেড়ামারা হার্ডিঞ্জ ব্রীজের অদূরে পুর্ব পাশে কয়েকটি ট্রলার রয়েছে। সেটি থেকে পাইপের সাহায্যে খোলা মাঠে বালু তোলা হচ্ছে। ট্রলারের সঙ্গে তিনটি খননযন্ত্র (ড্রেজার) রয়েছে। ওই ট্রলারের মাঝি, সারেং ও শ্রমিকেরা বলেন, সাইফুজ্জামান পিন্টু ট্রলার গুলো পরিচালনা করছেন। কর্মচারীরা যন্ত্রের সাহায্যে নদী থেকে বালু ট্রলারে তোলেন। পরে ট্রলার থেকে খোলা জায়গায় নেওয়া হয়। পাকশী ইউনিয়ন ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা নদীর বিভিন্ন অংশ থেকে বালু তুলে তাঁরা পাবনা, চাটমোহর, নাটোর ও লালপুর উপজেলার বিভিন্ন ব্যবসায়ী, বাড়ি, পুকুর-ডোবা-বিল ও ঠিকাদারদের সরবরাহ করে থাকেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাঙনের শিকার স্থানীয় কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, প্রতি বছর ড্রেজার মেশিন আর ট্রাক্টরে করে নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় বন্যার সময় এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়। এতে গত বছর বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন নদী তীরবর্তী প্রায় কয়েকটি পরিবার। কিন্তু বেপরোয়া বালু ব্যবসায়ীদের কোনোভাবে থামানো যাচ্ছে না। নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি জানান স্থানীয়রা।
অপরদিকে, সরকারি নিয়মনীতি না মেনে পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষা ঈশ্বরদীর ইটভাটা অঞ্চলখ্যাত লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে ৫২টি ইটভাটা, যার মধ্যে অধিকাংশেরই নেই অনুমোদন। আর অবৈধ এসব ইটভাটায় চরের খাসজমি ও নদীর পাড় থেকে লুট করা মাটি সহজে আনার জন্য পদ্মার বুকে ইট, সুরকি ও বালি দিয়ে মজবুত করে তৈরি করা হয়েছে সড়ক। এই সড়ক দিয়ে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা চলছে মাটিবোঝাই ১০ চাকার ড্রামট্রাক ও ভারী ট্রাক্টর। এসব সড়কের কারণে পরিবর্তন হচ্ছে পদ্মার গতিপথ। শুকিয়ে গেছে নদী, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। রাস্তা নির্মাণের কারণে পদ্মার স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ায় দেশের অন্যতম প্রধান এই নদীর জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি আগের মতো আর মাছ পাচ্ছেন না স্থানীয় মৎস্যজীবীরা। ইটভাটা মালিকরা প্রকাশ্যেই নদীর বুকে এসব সড়ক বানানোর কাজ শেষ করলেও তা রোধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন।
সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের কৈকুন্ডা, বিলকেদা ও কামালপুর এলাকায় গিয়ে পদ্মা নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা। সেখানে কৈকুন্ডা, বিলকেদা, শাহপাড়া, ডিগ্রিরচর, চরমাদিরারচর ও শানিকদিয়াড় চরের সরকারি খাসজমি ও পদ্মা নদীর পাড় কেটে মাটি লুট করে ইটভাটায় আনতে দেখা যায় ইটভাটামালিক এবং ক্ষমতাসীন দলের ‘মাটিদস্যু’ চক্রের সদস্যদের নিয়োগ করা শ্রমিকদের। বর্ষায় পদ্মা নদীর এ অংশটি বেগবান থাকলেও শীতে হাঁটুসমান পানি থাকে। সেখানে প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ছয়টি সড়ক তৈরি করায় নদীটি যেন পাড় বাঁধা ১০টি পুকুরে পরিণত হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নেই ইটভাটা নির্মাণে সরকারি নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠেছে ইটভাটা। চলতি ইট উৎপাদন এই ইউনিয়নে ৩৮টি ভাটা চালু রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি হাওয়া ভাটা ও ৩৫টি চিমনি ভাটা। দুটি হাওয়া ভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র থাকলেও বাকি ৩৬টি ভাটারই নেই কোনো অনুমোদন। যে কারণে প্রতি বছরই মৌসুমের শেষ দিকে পাবনার জেলা প্রশাসকের নির্দেশে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ভাটাগুলোতে অভিযান চালিয়ে নামমাত্র জরিমানা ও ভাঙচুর করা হয়। তবে এবার মৌসুম শেষের দিকে চলে এলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এবার এই ৩৮টি ইটভাটার জন্য ১৭টি এক্সকেভেটর দিয়ে পদ্মা নদীর পাড় ও ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। এ সকল ভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোর অভিযোগে করেন শ্রমিকরা।
ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামালউদ্দিন জয়েরও দাবি, স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ঠ দের জানিয়ে মাটি কাটার কাজ ও ইটভাটা চলছে। ইটভাটার জন্য পদ্মা নদী থেকে মাটি কাটার বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। তবে ইটভাটা বাদে পদ্মা নদী থেকে মাটি কেটে অন্য কোথাও বিক্রি না করতেও নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন।’
পাবনা অঞ্চলের পদ্মা নদীর অনেক স্থানেই অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে জানিয়ে বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন পাবনা- শাখার সভাপতি খন্দকার নাজমুল হক বলেন, এই অঞ্চল অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের স্বর্গরাজ্য। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এরা বেপরোয়া। প্রশাসন সবকিছু জানার পরও বেশিরভাগ সময় নীরব থাকে। নদীভাঙনে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকেও এরা আমলে নেয় না।’
এ সকল বিষয়ে অভিযুক্ত অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন কারি পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও অঃলীগ নেতা সাইফুজ্জামান পিন্টু বলেন, আপনি ওসি, এসপি না ডিসি আপনাকে এ সব বলবো। আমাকে আর কখনো ফোন করবেন না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পাবনা কৃষি খামারবাড়ির উপপরিচালক কৃষিবিদ আবদুল লতিফ জানান, ফসলি জমির মাটি কাটা আইনত অপরাধ। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি নিজের জমির ফসল নষ্ট করে ইটভাটার কাছে মাটি বিক্রি করে তাহলে কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে? এ বিষয়ে কৃষি বিভাগের তেমন কিছু করার থাকে না। বিষয়টি ইউএনও দেখভাল করেন।’
ঈশ্বরদীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পিএম ইমরুল কায়েস বলেন, পদ্মা নদীতে বাঁধ দেওয়া ও ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুই-এক দিনের মধ্যেই ভাটাগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হবে।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাবনার জেলা প্রশাসক (ডিসি) বিশ্বাস রাসেল হোসেন বলেন, এটি কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে হওয়ায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। পাবনার পুলিশ সুপার (এসপি) মহিবুল ইসলাম খান বলেন, চলতি সময়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি পাবনা জেলার বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। যেকোনো অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে পাবনা জেলা পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত আছে। এসব বালু দস্যুদেরকে সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে হবে।