মুক্তিযুদ্ধের গল্প। রাকিব হাসান

0

দাদীর কাছে যতবার শুনেছি সে ইতিহাস, ততবার-ই তাঁর চোখ জলে ভিজে গেছে।৭১-এ বাবা তখন এইচ.এস.সি’র ছাত্র। দাদা মুক্তিযুদ্ধে গেছেন; আর দাদী মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার এবং অস্ত্র সরবরাহ করতেন। সেসময় বাড়ীতে এসে কাউকে না পেয়ে গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার রুহুল আমিনের সহায়তায় বাবাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী সেনারা।কয়েকদিন পর আমাদের দো-চালা টিনের ঘরটি খুলে নিয়ে যায় রুহুল আমিন ও তার লোকজন। আর বাকী ঘরগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়।মাঠের পাকা ধান, গরু-বাছুর, পুকুরের মাছ সব হরিলুট হয়ে যায়।আত্নরক্ষায় দাদী তখন বাড়ীর পশ্চিম পুকুরে কুচুরীপানার নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এদিকে মক্তিযোদ্ধার সন্তান হবার অপরাধে বাবাকে এক সপ্তাহ আটকে রেখে ব্যাপক মারধর করা হয়। বার বার নির্যাতন করে তাঁর বাবা-মায়ের সন্ধান জানতে চাওয়া হয়। সব মার হজম করেও তিনি তাঁর বাবা-মায়ের সন্ধান দেননি। এরপর তাঁকে অস্ত্রের মুখে পাক সেনাদের গাড়ী পরিষ্কার করানো এবং মাটি খোঁড়ানোর (বাঙ্কার) কাজ করতে বাধ্য করা হয়।পকেটে থাকা এইচ.এস.সি পরীক্ষার প্রবেশপত্র দেখিয়েও কোন কাজ হয়নি।কাজ না করলেই লাত্থি-ঘুষি কিংবা রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করা হতো। শেষ পযন্ত স্থানীয় এক ব্যক্তির সহায়তায় তিনি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসেন।
এদিকে ছেলে যেন হায়েনার হাত থেকে জীবিত ফিরতে পারে; সেকারণে বাড়ীর উঠোনে কোরান খতম দেয়া হয়, মিলাদ-দোয়ার আয়োজন করা হয়। দুইটা গরু-ছাগল কিনে সদকা দেন দাদী।আল্লাহর অশেষ রহমতে বাবা ফিরে আসেন। তবে তার সমস্ত শরীরে জখমের চিহ্ন। খবর শুনে সেই রাতে রাজাকারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে; ধানক্ষেতে হামাগুড়ি দিয়ে দাদা আসেন গ্রামে। তিনি বলেন-‘শত্রুদের হাতে এমনি এমনি প্রাণ দেয়ার চেয়ে যুদ্ধ করে শহীদ হওয়া ভালো’। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে চৌদ্দগ্রাম সীমান্তে চলে গেলেন তিনি। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে; আমার বাবাও তার বাবার সাথে সরাসরি ২নং সেক্টরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।(উল্লেখ্য দাদার প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিলো না, তিনি বৃটিশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে সফলতার স্বাক্ষর রাখায় সোর্ড অফ অনার পেয়েছেন। রানী এলিজাবেথ এর চিত্র খচিত তোলোয়ারটি এখনও সযতনে রাখা আছে)।
আমার দাদা ডা: লুৎফর রহমান ছিলেন কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট থানার তৎকালীন বাঙ্গড্ডা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি। একদিকে দাদা-বাবা যুদ্ধে; অন্যদিকে রাজাকারদের দৃষ্টিতে এর চেয়ে গুরুতর অপরাধ করেছেন দাদী! কারণ কয়েকটি হিন্দু পরিবারকে আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবারাহ এবং তাদের মজুদকৃত গ্রেনেড লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি।একদিন ছদ্মবেশে মাছ ধরতে আসা নাঙ্গলকোটের জোড্ডা এলাকার দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে সরবরাহ করেছেন দাদী। কিন্তু ছদ্মবেশ ধারণ করা এক মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়ার পর বিষয়টি রাজাকাররা জেনে ফেলেন।ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় দাদীকে দেখা মাত্র গুলির অর্ডার দেয়া হয় হানাদারদের ক্যাম্প থেকে। তাঁকে হন্য হয়ে খুঁজতে থাকে রাজাকাররা্। দাদী ফুফুদের নিয়ে আত্নীয়-স্বজনের বাড়িতে পালিয়ে বেড়ান।ভয়ে অনেকে আশ্রয়ও দিতে চাইতো না।মাসের পর মাস এক কাপড়ে ছুটে বেড়িয়েছেন।দিনের পর দিন শাক, লতা-পাতা খেয়ে বেঁচে ছিলেন।
একের পর এক গেরিলা যুদ্ধে শত্রুরা যখন পরাস্ত; দেশ যখন স্বাধীন হতে চলেছে; মুক্তিরা গ্রামে ফিরে আসছে-এমন খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন রাজাকার রুহুল আমীন। ১৫ ডিসেম্ভর রহুল আমিন তাকে বাঁচাতে আমার দাদীর পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেন। দাদী তাকে লাত্থি মেরে বের করে দেন। এরপর ১৬ই ডিসেম্ভর বাবাসহ সব মুক্তিযোদ্ধারা ঐ রাজাকারকে ধরে এনে গণধোলাই দেন; পরে ব্রাশ ফায়ার করে হরিশ্চর ব্রিজের উপর থেকে ফেলে দেয়া হয় তার লাশ।
এরপর আমাদের টিনের যে ঘরটি খুলে নিয়ে ঐ রাজাকার তার বাড়িতে ঘর দিয়েছিল; সেই ঘরটি খুলে আনা হয়, সেই ঘর দিয়ে শ্রীফুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন দাদা। এটি এখন সরকারী। পরবর্তীতে সেখানে হাইস্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এখন স্কুলটি পাকা হয়েছে। প্রতিটি বিজয় দিবসে স্কুলে বড় আকারে বিজয়ের অনুষ্ঠান করা হয়।সেই অনুষ্ঠানে এলাকাবাসী ফুলের মালা দিয়ে- ক্রেস্ট দিযে দাদা এবং বাবাকে সম্মানিত করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের কথা স্মরণ করেন এলাকার বিশিষ্টজনরা। দেখে গর্বে বুকটা ভরে যায়।(আর দাদী বরাবরই নিভৃতচারী।সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও মূলত তিনিও মুক্তিযোদ্ধা। তার পরিবার দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছে এটাই তাঁর কাছে গৌরবের। উল্লেখ্য,দাদা-দাদী ইন্তেকাল করেছেন ২০০৮ সালে। কিন্তু তাদের স্মৃতি এখনও অম্লান।)
সংক্ষেপে এই হচ্ছে আমার বাবা এবং তার বাবা-মায়ের যুদ্ধ জয়ের গল্প। দাদীর কাছে বহুবার এ গল্প শুনেছি। মাঝে মাঝে বাবা যখন ঘুমিয়ে থাকে; চুপি চুপি খেয়াল করে দেখি- তাঁর পিঠে এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই নির্যাতনের চিহ্ন!! আর মনে মনে ভাবি এটা কি সেই বাংলাদেশ; যার জন্য আমার বাবাকে ঐ অমানুষগুলো এভাবে নির্যাতন করেছিলো!!
যুদ্ধের পর ৭২ সালে এইচ.এস.সি এবং পরবর্তীতে ঢাকা টেক্সটাইল কলেজ (বর্তমানে টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশের পর বাবা বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনে চাকুরী করেন। সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে সারাজীবন নিষ্ঠা এবং সততার স্বাক্ষর রেখে এখন অবসরে আছেন; গ্রামে থাকেন। নানা ব্যস্ততার কারণে বাড়ীতে কম যাওয়া হয়, উনার সাথে দেখা হয় কম।
বাবা, সারাজীবন আমাদের মানুষ করার জন্য পরিশ্রম করেছেন। মানুষ হতে পেরেছি কিনা জানি না, তবে অন্যায়ের সাথে কখনও আপোষ করতে শিখিনি; আত্নসম্মানবোধকে কখনও জলাঞ্জলি দেইনি।পরিবারের কাছ থেকে এই শিক্ষাটুকু অন্তত ভালোভাবেই পেয়েছি।
যে বাবার জন্য আমার আজকের এই পৃথিবী, সেই বাবাকে কখনও মুখ ফুটে বলা হয়নি- বাবা, তোমার মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত, বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসি….খুউব…।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.