মায়াজালে এখনো আমি । আনান্নিয়া আন্নি

                                                                                 পর্বঃ ১৪
(১৫ নভেম্বর)
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ হয়ে গেলো। নীড় এর সাথে এখন রোজই কথা হয় আমার।আজ স্কুল থেকে কুমু কে আনতে গিয়েছি। নীড় ও এসেছিলো মহুয়া কে নিতে। রোজকার মতো দশ মিনিট আগেই স্কুলের গেটে পৌঁছে দাঁড়িয়ে রইলাম। এরইমধ্যে নীড় ও এসে গিয়েছে। সেদিনের মতোই আজও নীড় এর আবদার স্কুল ছুটি হওয়ার আগে আমার সাথে এক কাপ চা খেতে চায় সে। আজ আর আমিও ওর আবদার ফেলতে পারিনি। স্কুল এর সামনে একটা চা এর দোকানে বসে ওর সাথে গল্প করতে করতে বেশ জমিয়ে এক কাপ চা খেয়েছি। প্রথম বার এই অনুভূতি আমার কাছে ভীষণ সুন্দর ছিলো, বড্ড বেশিই সুন্দর ছিলো আজ স্কুল ছুটি হওয়ার আগের সেই দশ মিনিট সময় টুকু। আর সেই সুন্দর সময় টুকু ডায়েরি বন্দী করে ঘুমোতে যাচ্ছি আমি এই রাত দুপুরে।

(২০ নভেম্বর)
রাত ১ টা বেজে কুড়ি মিনিট। আজকাল আর ডায়েরি লিখবার সময় পাচ্ছি কই,সারাদিন রাত তো নীড় এর সাথে কথা বলতেই কেটে যাচ্ছে। হুট করেই আমার জীবনটা কেমন রঙিন হয়ে উঠেছে, হঠাৎ করেই জীবনটা যেনো একটু বেশিই সুন্দর হয়ে উঠেছে আমার। আজ বৃহস্পতিবার, কাল প্রথম বার নীড় এর সাথে দেখা করতে যাবো সেই ঝিলপাড়ে। মনের মধ্যে সীমাহীন উত্তেজনা কাজ করছে আমার আজ…

(২১ নভেম্বর)
অনেক বছর পর আজ ওয়ারড্রব থেকে মায়ের সেই মেরুন রঙের জামদানী শাড়ি-টি বের করলাম,শাড়ি টা আজও কেমন নতুন রয়েছে। আমার মনে আছে বিবাহবার্ষিকী তে বাবা এই শাড়ি টি এনেছিল মায়ের জন্য। মা ঐ একদিনই শাড়ি টি পরেছিলো। অনেক বছর আগের কথা তারপর ও শাড়ি-র ভাজ খুলতে গিয়ে বাবা মায়ের কথা আজ বড্ড মনে পরছে,মনের অজান্তেই চোখ দুটো যেনো ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। নীল রঙের ব্লাউজ এর সাথে মেরুন রঙের জামদানী শাড়ি টি পরে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই যেনো আজ সম্পুর্ন নতুন রুপে নিজেকে আবিষ্কার করেছি আরো একবার। সবসময় খোঁপায় গাজরা পরতে আমার ভীষণ ভালো লাগে, তাই বড় ভাবি নিজে খোঁপায় গাজরা পরিয়ে দিয়েছে আজ।

চোখে আজ বেশ গারো করে কাজল দিয়েছি, কপালো কালো টিপ আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়েছি আজ। নীড় বলেছিলো, বলেছিলো না আবদার করেছিলো। তার আবদার রাখতেই আজ আমার এই সাজ!

আমার কোনো কিছুই বড় ভাবির চোখ থেকে আড়াল করতে পারিনা আমি বরাবরই। বড় ভাবি যেনো মায়ের মতো আমার ভেতরে হওয়া সুখ দুঃখ সবটাই বুঝতে পারে। ইমাদ এর সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে নেওয়ার পরও আমি আজকাল বড্ড বেশি খুশি থাকি সেটা বড় ভাবির চোখ এড়ায়নি। আড়াল করতে পারিনি কিছুই তার থেকে। আজকে বেড়োনের সময় আমার শাড়ি-র কুচি ধরতে ধরতে ভাবি-র মুখে আমি কেবল একটা কথাই বলতে শুনেছি ;
তোমার ভালো থাকাটাই আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তুমি খুশি আছো সেটা দেখেই আমাদের শান্তি।

বিকেল পাঁচটায় গিয়ে পৌঁছলাম ঝিলপাড়ে। সে এখনো আসেনি। অথচ কথা ছিলো ঠিক পাঁচটায় পৌঁছনোর। আজকে ঝিলের লাল শাপলা গুলো যেনো আরো বেশি সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। আমি সেদিনের মতোই পা মেলে বসে অপেক্ষা করছি তার জন্য।

মিনিট দশেক অপেক্ষা করালো সে আমায়। ওই তো দেখতে পাচ্ছি আসছে সে। আমিও অভিমানের ছলে মুখ টা ঘুরিয়ে বসলাম, কেনো আমাকে অপেক্ষা করালো সে?

অভিমান বড় সোহাগি বস্ত সোহাগ চায় যে সে…
এক চিলতে অভিমান জমেছে তার আমার কাছে এসে..

কে বলেছে আমি অভিমান করেছি?

ওই যে হালকা অভিমানে ঘুরিয়ে নেয়া মুখখানা-ই বলে দিচ্ছে সে অভিমান করেছে আমি তাকে অপেক্ষা করিয়েছি বলে।

কেনো অপেক্ষা করালেন?

তার খোঁপায় তাজা বেলি ফুলের মালা পরিয়ে দেবো বলে এই মালাখানি কিনতে গিয়েছিলাম নিউমার্কেট, ফেরার পথে রাস্তায় হালকা জ্যাম ছিলো বলে হালকা দেরি হয়ে গেলো আর তার জন্য সেও হালকা অভিমান করে বসে রইলো…

তার কথায় যেনো সব মান অভিমান নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো;এতো নিখুঁত ভাবে কি করে বোঝে সে আমায়?

তারপর আর কোনো কথা না বলে সে আমার মাথার নকল ফুলের গাজরা টি খুলে তার আনা সেই বেলি ফুলের মালাখানি পরিয়ে দিয়ে বললো;

সে ডেকেছে আমায়..
এসেছি তার কাছে
আগলে রাখবো তাকে..
ভীষণ ভালোবেসে।

আগলে রাখতে দেবেন তো আমায়? ভীষণ ভালোবেসে আগলে রাখবো আপনাকে।

সারাজীবন থাকবেন তো আমায় আগলে রাখার জন্য? পরে আবার আমার ওপর ঘৃনার পাহাড় চাপিয়ে চলে যাবেননা তো নীড়?
কথাগুলো বলেছিলাম তবে মনেমনে, তাকে জানতে দেয়নি আমার মনের ভেতরে তার জন্য অনিশ্চয়তার যে বেড়াজাল ঘিরে রয়েছে। আমি কেবল চুপচাপ তার বলা কথাগুলো মন দিয়ে শুনে চলেছি…

তারপর গল্পে গল্পে ঘড়ির কাটা ঘুরতে ঘুরতে জানান দিলো আমাদের..
এবার উঠতে হবে, ফিরতে হবে বাড়ি।

বাড়ি ফেরার পথে মানুষ টা পরম যত্নে আমার হাত খানা ধরে রাস্তা পার করিয়ে, আমাকে বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে আজকের মতো বিদায় নিয়েছে সে। বিদায়বেলা সে বারবার পেছন ফিরে আমায় দেখার চেষ্টা করছিলো, ওর সেই আমাকে দেখবার চাহনি টা আমার চোখের সামনে এখনো ভাসছে….

ঝিলি…
ভালো করে খেয়াল করছিস তো? ছোট কাকা আবার দুম করে চলে না আসে দেখিস?

আমি দেখছি তুই পড় কুমু।

এরইমধ্যে দরজায় একজন লোক এসে হাজির। বেশ লম্বা মতো, ফর্সা করে, লোকটা আর কেউ নয় ছোট ফুপু-র হাসবেন্ড। এই সেই ভদ্রলোক যার সাথে সবকিছু বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও ছোট ফুপু-র সাথে তার বিয়ে হয়েছে আর তিনিই রয়ে গিয়েছেন শেষ অব্দি। সত্যিই ছোট ফুপু-র জীবন টা শেষ করে দিয়ে রয়ে গিয়েছেন তিনি। আজ যেনো কুমু আর ঝিলি আবারও নতুন করে দেখছে তাকে। এই সেই ভদ্রলোক, ছোট ফুপু-র সেই প্রেমিক পুরুষ ইমাদ…..

চলবে❤️

আনান্নিয়া আন্নিমায়াজালে এখনো আমি
Comments (0)
Add Comment