সুখের বৃত্তান্ত । মোহীত উল আলম

সুখের বৃত্তান্ত

মোহীত উল আলম

রুনা লাইলার একটা গান আছে, ‘সুখ, তুমি কী বল, জানতে ইচ্ছে করে, আমার জানতে ইচ্ছে করে।’ এই গানটার উল্লেখ করে ‘সুখ’ বিষয়ক একটা আলাপের সূত্রপাত করতে চাইছি। তারও একটা কারণ আছে। করোনাকালে সবার মনের পেছনে একটি আতংক কাজ করছে, ‘কখন ধরা খাই’। কিন্তু মানুষের মন হচ্ছে মেঘ আর রৌদ্র। যখন করোনার মেঘ তার মনের চরাচরে কালো ছায়া ফেলছে, সে খুঁজে বেড়াচ্ছে রৌদ্রকে। তারই ফলস্বরূপ ভরে উঠছে মেসেঞ্জার আর ফেইসবুকে রৌদ্রমাখা সুখচ্ছবি। ‘ক্ষ্যাপা খুঁজে ফিরে পরশ-পাথর’-এর মতো মানুষ এখন খুঁজে ফিরছে সুখকে। আমার কাছে পাঠানো বহু কিসিমের সুখচ্ছবিকে আমি মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করেছি। এক ভাগ বলছে, সুখ আসলে স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ, অসুখও যেমন স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ। আরেক ভাগ বলছে, সুখ মোটামুটি শ্রেণিচরিত্র বিশেষায়িত, যত ধন তত সুখ। ঠিক তারই পাশাপাশি আরেক ভাগ শ্রেণিচরিত্রের মধ্যে নিহিত বিপরীতধর্মিতাকে আশ্রয় করে বলছে ধন যত কম, সুখ তত বেশি: নজরুল যেমন বলেছেন, ‘হে দারিদ্র, তুমি মোরে করেছো মহান।’ শেষের দুই ভাগ অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত ধারণা, আর প্রথম ভাগটি হচ্ছে শ্রেণি-চরিত্র নিরপেক্ষ, তাই হয়তো সর্বজনীন এবং কিছুটা আধ্যাত্মিক, যেখানে বলা হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তাই একমাত্র সুখের নিশ্চয়তাকারী।
তবে আমার ধারণায়, সাধারণভাবে মানুষ সুখ এবং অসুখের মধ্যে খুব একটা তারতম্য দেখে না। বা বুঝতেও পারে না। কারণ, মানুষ জীবনটার সামনাসামনি মুখোমুখি হয়ে জীবন চালায়; যেন সে সবসময় একটা বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে এরকম একটা ব্যাপার। সমাজের বেশিরভাগ মানুষ নিজের জীবনের এক পর্যায়ের সঙ্গে আরেক পর্যায়ের তুলনা করে চলে না। সকলটিই বর্তমান তার কাছে। সকল কিছুকেই গ্রহণ করে সে জীবনে চলে বা চলতে বাধ্য হয়। সুখ-অসুখ মিলে মিশে ‘দু:খ সুখের দুইটি ধারা’ (সোলস ব্যান্ডের একটি পুরোনো গান।) মিলে জীবনের নহর প্রবহমান। বেশিরভাগ মানুষ তাতেই বিশ্বাস করে। খুবই আস্তিক্যবাদী সমাজে মানুষ জীবনের পুরোভাগটা সৃষ্টিকর্তার ওপরে সমর্পন করে দিয়ে ‘যা থাকে কপালে’ এভাবে চলে।
তারপরও ‘অসুখ’ যেমন একটা ’কনসেপ্ট’, সুখও সেরকম একটা কনসেপ্ট। এই আলোচনায় তাই ব্যক্তিগত সুখানুভূতি নিয়ে যেমন কথা আসবে, তেমনি আসবে ‘সুখ’ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি ডিসকোর্স বা বিষয় হিসেবে। দেখি, আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাই।
ব্যক্তিগত সুখ টার্গেটধর্মী। কারো লক্ষ্য প্রেম, কারো লক্ষ্য বিদ্যা, কারো লক্ষ্য অর্থ, আবার কারো লক্ষ্য খ্যাতি, আবার দেশপ্রেম, মানবসেবা ধরনের মহৎ লক্ষ্যগুলোও ব্যক্তিমানুষের টার্গেট। এই টার্গেটগুলি অর্জিত না হলে ব্যাক্তিমাত্রই নিজেকে অসুখী ভাবতে পারে। অনেকসময় মানুষ এককাট্টা হয়ে নিজের কোন একটা লক্ষ্যের সঙ্গে পুরো জীবনটাকে তুলমূল্য করে ফেলে, এবং সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে তারা শুধু অসুখী হয় না, হতাশায়ও ভোগে। আর ব্যক্তিজীবনে সুখ হারানোর আরেকটি বড় কারণ হলো শারীরিক, শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে মানুষ নিজেকে অসুখী ভাবতে পারে।
যা হোক, প্রথমে আলোচনায় আনি, ধন যত সুখ তত—এ কথাটাকে। এ কথাটা প্রথাগত ধারণার বিপরীত হলেও কিন্তু সামাজিকভাবে সত্য। মানুষ মাত্রই ধনের পেছনে ছোটে। মানুষের মনের এই প্রবণতার সজীবন্ত উদাহরণ হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের ’গোল্ড রাশ’ বা স্বর্ণের জন্য ধাওয়া, বা আমাদের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষিত লোকের জন্য কানাডা-আমেরিকায় অভিবাসন নিয়ে শিক্ষকতা থেকে শুরু করে বাসনকোষন ধোওয়া পর্যন্ত চাকরি নিয়ে সুখে থাকা—আর শ্রমজীবী মানুষের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা মালয়েশিয়ায় গিয়ে কামলাগিরি করা।
কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র যখন ছিলাম, তখন বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বিরাজিত বিশাল স্বপ্ন দেখতাম ডাক্তার-প্রকৌশলী হবে, কিংবা আমলা, আর থার্ড চয়েজ ছিল শিক্ষকতা। এবং বুঝতাম এগুলি কোনটিই তাদের নিজেদের ইচ্ছার প্রতিফলন ছিলোনা, ছিলো অভিভাবকের ইচ্ছার প্রতিফলন। আরো পরে বুঝলাম, অভিভাকদের মনে ছেলেকে ডাক্তার-প্রকৌশলী বানানোর পেছনে বিজ্ঞান চর্চার বা রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করা বা কীভাবে নদী-শাসন করা যায় তার ফর্মূলা আবিষ্কারের কোন উদ্দীপনা কাজ করতো না, করতো শুধু এই চিন্তা যে ছেলে ডাক্তার-প্রকৌশলী হয়ে অনেক টাকা উপার্জন করবে, এবং তাই দিয়ে একটি বৈষয়িক শান্তি অবধারিতভাবে নিশ্চিত হবে, এবং তখন আসবে সুখ। তারপরও অভিভাবকদের এই সংকীর্ণ ‘ব্যাকপকেট’-নির্ভর চিন্তাকে আমরা সংকীর্ণ বলে গালমন্দ করলেও কিন্তু এটির নিরেট বাস্তবতা হচ্ছে মানুষ ধনের পেছনে ছুটবেই, নিজে না পারলে ছেলেকে ছোটাবেই। আমেরিকার নাট্যকার হেনরি মিলারের বিখ্যাত নাটক ডেইথ অব আ সেইলসম্যান এ চিন্তারই নাট্যরূপ। বাবা উইলি লোমান নিজে আমেরিকার স্বপ্নকে ধরতে পারেন নি, কিন্তু ছেলে দু’টোকে দিয়ে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে গিয়ে দেখলেন, ছেলে দু’টো তাঁর বিরাট স্বপ্নকে রূপ দেবার কোন ইচ্ছা পোষণ করে না। ‘বাবা যে ছেলে নয়, বা ছেলে যে বাবা নয়’ জীবনের এই পরম সত্যটা আমরা অনুধাবণ করতে পারি না বলে অসুখী হয়ে যাই।
ধন উপার্জনের পথে উল্টোভাবে বললে সবচেয়ে বড় শত্রু হলো নৈতিকতা। আমার এক স্কুল বন্ধু প্রথম জীবনে কাস্টমসে ঢুকে খুব একটা মানসিক যাতনায় পড়ে গেছিলো। অচিরেই তার সততার জন্য সে ‘চেইন-ব্রেকার’ হিসেবে তার সহকর্মীদের শত্রুতে পরিণত হলো, এবং বদলী হয়ে গেল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিলেটের কাস্টম হাউজে। চিত্রকল্পের মাধ্যমে বললে জাপান থেকে মিয়ানমারে চলে আসা।
ধন উপার্জনের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক হলো আপন আঁতুড়ের ভাইয়ের মতো। উত্তরাধুনিক ফরাসী চিন্তাবিদ ফুকো বলেছেন, ক্ষমতার নেটওয়ার্কিংটা হচ্ছে ওপর থেকে নীচে, নীচে থেকে ওপরে প্রবহমান একটি পরিক্রমণ, যার তিনি নাম দিয়েছেন, প্যানোপ্টিকন বা যার বাংলা করা যায় সর্বেব নিয়ন্ত্রণ। এই মতে, ধন-ক্ষমতা-নিয়ন্ত্রণ এই ত্রিপদী কাঠামো নির্ণয় করার পর সুখ নামক বস্তুটাকে কীভাবে নির্মিত করা হবে তাই ঠিক করা হয়। তাই দেখা যায়, এখন ঘন ঘন কর্তৃপক্ষীয় বার্তা আসে মেসেঞ্জারে বা মেসেজে যে আপনার সকল প্রযুক্তিগত ব্যবহারের ওপর কর্তৃপক্ষীয় নজর রাখা হচ্ছে। এটি ফুকোর প্যানোপটিকন ধারণারই প্রতিফলন। অর্থাৎ, কর্তৃপক্ষীয় ভাষায় যত নিয়ন্ত্রণ, তত সুখ। আবার ক্ষমতার নেটওয়ার্কিংটা দেখা যায় মোটা দাগে রাজনৈতিক, কিন্তু তলায় তলায় পুরোটাই অর্থনৈতিক, যেখানে রাজনৈতিক পরিচিতি কেবল পাসওয়ার্ড হিসেবে কাজ করে। যেমন গরুর হাটের টোল তোলা বা সদ্য নির্মানসমাপ্ত সেতুর ইজারাদারী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দেওয়া হয় তাদের অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা প্রশমনের জন্য, সাথে সাথে দল ভারী রেখে রাস্তা দখলে রাখার জন্য। কিন্তু এটা হলো ওপরের দিক, যে কারণে ক্ষমতার বিন্যাসের আলাপ করতে গিয়ে ফুকো বলেছেন, দেখা যাবে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানের রাজধানীতে বসবাসকারী তাঁদের অনেক মন্ত্রী-অমাত্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও, মফস্বলের শীর্ষ ছাত্রনেতার সঙ্গে ঠিকই যোগাযোগ থাকে। এভাবেই ক্ষমতার মানচিত্রটা তৈরি হয়, তবে এই ওপরের যোগাযোগের নীচের পর্যায়টা হচ্ছে ভয়াবহ রকমের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত—সেখানে রাজনীতি, ধর্ম, গোত্র, সবকিছুই দ্বিতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা অর্থনৈতিক বিবেচনাকে নিয়ন্ত্রণ করে না, অর্থনৈতিক বিবেচনা রাজনৈতিক বিবেচনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ জন্য মাঝে মাঝে আমরা মিডিয়ায় চমকে ওঠা খবর দেখে হতভম্ব হয়ে পড়লেও, বুঝতে হবে ঐসব খবরের ’সাবজেক্ট’দের অর্থনৈতিক সক্ষমতা তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বা গোত্রীয় পরিচয়কে খাটো করে দিয়েছে। ধরেন ওয়াল স্ট্রিটের কথা—পৃথিবীর সবচেয়ে ধনবান রাজপথ, ছোট্ট একটি সড়ক, কিন্তু গোটা পৃথিবীকে বলতে গেলে শাসায়। এবং এটি সর্বজনবিদিত যে ওয়াল স্ট্রিট চালায় ইহুদিরা।
এ্‌ইবার এই ভাগের, অর্থাৎ ধন যত সুখ তত, সেখানে সুখ-ধন-এবং নৈতিকতার সাংঘর্ষিক দিকটি নিয়ে আলাপ করি। আমেরিকার ধনবাদী বা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক রাজনীতির অন্যতম প্রবক্তা আমেরিকার অষ্টাদশ শতাব্দীর বিজ্ঞানী মনীষী বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন খ্রিস্টান ধর্মের ‘দারিদ্রই মহত্ব’ নীতির অনুসরণে মনে করতেন সৎভাবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপাজর্নের মাধ্যমে সুখ অর্জন করার মধ্যে খারাপ কিছু নেই। তাঁর এই দর্শনের নাম হলো সাকসেস এথিকস বা সাফল্যের নৈতিকতা। শুধু আমেরিকার সমাজে নয়, বাংলাদেশের সমাজেও মানুষ বড় হয় এই আপ্তবাক্য শুনে যে সৎভাবে পরিশ্রম করে সাধু জীবনযাপনের মধ্যেই সুখ নিহিত। তবে পার্থক্য হলো, ফ্রাংকলিন যেমন সততা-পরিশ্রম-ধন-সুখ, এই চর্তুমাত্রিকতার মধ্যে জীবনের নৈতিকতা খুঁজে পেয়েছিলেন, আমাদের সমাজে সততা-পরিশ্রম-সুখ এই ত্রিমাত্রকতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, আর ধন আসতেও পারে, না আসতেও পারে।
কিন্তু সামাজিক খেলাটা হচ্ছে, এই ত্রিমাত্রিকতাকে পছন্দ করতে না পারা। কারণ, এই ত্রিমাত্রিকতার মাধ্যম প্রতীয়মান হচ্ছে, পরিশ্রম সুখ আনলেও ধন না ও আনতে পারে, এবং সেটা মেনে নেওয়াটাই মহত্ব। ‘সবর’ আরবিতে, ‘সবুর’ বাংলায়। সততা আর পরিশ্রম নানা সামাজিক কারণে আমাদের সমাজে বিত্তের পরিপূরক নয়। এইখানেই রয়ে গেছে মূল দ্বন্দ্বটা। কারণ আমেরিকার সমাজে শ্রমের মূল্য থাকলেও, আমাদের দেশে নেই। কেন নেই, তার একটি বড় কারণ হচ্ছে, আমাদের সামাজিক, ধর্মীয়, গোত্রীয় চিন্তা হচ্ছে সামন্তবাদী, যা আধুনিককালে আমরা সাম্প্রদায়িকতা (শুধু ধর্মীয় অর্থে নয়) হিসেবেও দেখতে পারি। এই ধরনের চিন্তা প্রাধান্য পেলে সততা, শ্রম, দক্ষতা বা উদ্যম আর রাস্তা করতে পারবে না। এটা বলা যাবে না যে আমেরিকাতে বা অন্যান্য উন্নত দেশে এ ধরনের সামন্তবাদী-সাম্প্রদায়িকতা নেই, কিন্তু সেখানে সমাজের মূল বটগাছের সেগুলি হচ্ছে প্রশাখা, কিন্তু আমাদের বটগাছের মূল কান্ডটাই হচ্ছে পুরোটা সামন্তবাদী-সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে তৈরি।
যখন পরিশ্রম বা সততার ন্যায্যতা বা দক্ষতার স্বীকৃতি মিলবে না, তখন চোরাপথগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে এত বিপুল পরিমাণে যে নাগরিক জীবন ব্যাহত হতে থাকে। দক্ষতা ও পরিশ্রম সম্পর্কে একটা কথা বলতে হয়। এ দু’টো গুণ অনেকটা টাকার মতো—স্থান, কাল, পাত্র এবং চরিত্র নিরপেক্ষ। যে কোন লোক তার চরিত্র-ব্যতিরেকে দক্ষ বা অদক্ষ হতে পারে। একজন সৎ প্রকৌশলী দক্ষ হতে পারেন বা নাও হতে পারেন। অর্থাৎ, সৎ লোক মাত্রই দক্ষ, এবং অসৎ লোক মাত্রই অদক্ষ এ কথা বলা যাবে না, এবং এ কথাও বলা যাবে না যে, সৎ লোক মাত্রই পরিশ্রমী, এবং অসৎ লোক মাত্রই অপরিশ্রমী। এ বিষয়গুলি নিয়োগকর্তাদেরকে ভীষণভাবে ফাঁপড়ে ফেলে। কারণ নিয়োগ দেবার বেলায় রেফারেন্সগুলো সামন্তবাদিতার কারণে পক্ষপাতদুষ্ট থাকলে তখন কেউ যোগ্য লোক বলে প্রতীয়মান হলেও, তার সর্ববিধ ব্যবহার বা চরিত্র সম্পর্কে নিয়োগদানকারীর জানা নাও থাকতে পারে। এ ব্যাপারটা আরো জটিল হয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সনদের সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষালাভের যৌক্তিক সম্পর্ক না থাকাতে।
সামাজিক লেনদেনের পরিপ্রেক্ষিতে নৈতিকতার সংকটময় অবস্থান দেখে চতুর ইংরেজ মনীষী ফ্রান্সিস বেকন তাঁর “অব ট্রুথ” রচনায় বলেছিলেন, যে স্বর্ণ খনি থেকে তোলা হয়, সেটি বাজারে চালাতে গেলে তাতে খাদ মেশাতে হয়। ইঙ্গিত তাঁর এই যে বাইবেলের ধ্রুব সত্যতা নিয়ে সমাজে চলা যাবে না। বেকনের এই প্রয়োগসিদ্ধ দর্শন পশ্চিমা সমাজ মেনে চললেও তাদের শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা যেহেতু আছে, দক্ষতার বিচারে নিরপেক্ষতার প্র্যাকটিস যেহেতু আছে—যেগুলি বুর্জোয়া সমাজ এবং অর্থনীতির মূল নীতি –সেগুলি তাদের রক্ষাকবচ হওয়াতে বেকনের কথা মেনে নিলেও তাদের ধনবান হতে অসুবিধা হয় নি। অর্থাৎ তারা সৎভাবে পরিশ্রম করেও ধনবান হতে পেরেছে, যদিও এটি একটি প্রশ্নবিদ্ধ প্রতীতি। আমাদের সমাজেও ছেঁড়া কাঁথা থেকে সততা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ধনকুবের হয়েছে এরকম বহু নজীর আছে, কিন্তু শ্রম-মেধা-যোগ্যতা-দক্ষতা ও সততা মিলে যে সামাজিক একটি ‘ব্যবহার’ তৈরি হয়, সেটি আমাদের দেশে এখনো হয়ে ওঠেনি। সেজন্য আমাদের সুখানুভূতি হচ্ছে অপরের বেশি-সুখের প্রতি চাপা দীর্ঘ-নি:শ্বাস জড়িত তুলনাভিত্তিক হীন্মন্যতা।
তা হলে হচ্ছে কী? যখন আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে, পরিশ্রম-যোগ্যতা-দক্ষতা ও সততার উপযুক্ত স্বীকৃতি মিলছে না, অর্থাৎ সততা-পরিশ্রম-ধন-সুখ এই চর্তুমাত্রিকতা সঠিকভাবে কাজ করছে না, এবং তার ফলে সুখও আসছে না, তখন সাধারণভাবে মানুষ মনে করছে যে ধন না থাকাটাই সুখের পরিপূরক—অর্থাৎ যত কম ধন তত বেশি সুখ। সে জন্য শুরুতে যে ভিডিও চিত্রগুলির কথা বলেছি, যেগুলিতে দারিদ্রের মধ্যে সুখ নিহিত আছে বলে ধারণা প্রচার করা হচ্ছে, সেখানে কোনটাতে আছে, একজন বৃদ্ধ ভিখারি ছেড়া কাঁথার মধ্যে শুয়ে তার নাতিকে বর্ণমালা শেখাচ্ছে, বা কোন একটাতে একজন শ্রমিক নারী ইট ভাঙ্গার সময় শিশুকে নিশ্চিন্ত মনে স্তন দিচ্ছে, বা আর কোন একটাতে একটি টোকাই ছেলে যার একটি পায়ের স্যান্ডেল ছেঁড়া সে কীভাবে অপর একটি সম্পন্ন পরিবারের শিশুকে জুতোসহ ট্রেনে উঠতে সাহায্য করল, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ধরনের সচিত্র ছবিগুলির মধ্য দিয়ে এ ধারণা প্রচারিত হয়েছে যে দারিদ্র=মানবতা=মাহাত্ম্য=সুখ।
এই ধরনের সরলীকরণ সুখচ্চিত্র যারা পাঠান তারা একবারও নিজেদের অবস্থানগত মানসিকতা থেকে এগুলির প্রয়োগ সম্পর্কে চিন্তা করেন বলে মনে হয় না। ব্যাপারটার মধ্যে যে নিখাদ কপটতা আছে এটি আমরা বুঝতে পারি না কেন? তার কারণ হচ্ছে দারিদ্রের কশাঘাতে যারা জর্জরিত তাদের জীবনের অভিজ্ঞতায় না গিয়ে তাদের মধ্যে মাহাত্ম্য খুঁজে পাবার প্রবণতার মধ্যে যে সহানুভূতিহীনতা আছে, অমানবিকতা সেটা আমরা বুঝতে চাই না। ছেঁড়া-কাঁথায় শোয়া যে বৃদ্ধের মাহাত্ম্য প্রচার করা হচ্ছে, তার সে জীবন কি প্রকৃতই আমরা কেউ চাই? দারিদ্রের মধ্যে থেকে অবশ্যই মহান হওয়া যায়, কিন্তু মহান হওয়ার জন্য দারিদ্র শর্ত হতে পারে না। তা হলেতো সমাজ পেছনের দিকেই ছুটতো—বলতো, ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য, লও এ নগর। কিন্তু সেটা আমরা কল্পনায় মনে করি, বাস্তবে চাই না।
শেক্সপিয়ারের এ্যাজ ইউ লাইক ইট নাটকে গ্রামীণ অর্থনীতির মূল প্রবক্তা রাখাল কোরিন বলছে, এই যে আমার ভেড়াগুলি আমার চোখের সামনে চড়ছে, এতেই আমি মহা খুশি, আমার আর কিছু লাগে না। আর শহরের মূল প্রবক্তা টাচস্টোন বলছে, কিন্তু তোমার এখানে শহরের আমোদ নেই, সমাজ নেই, আমিতো খুব তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ব। তুমি প্রকৃতি দার্শনিক, কিন্তু আমি সেটা চাই না। টাচস্টোনের নিকষ বাস্তববাদিতা হয়তো আমরা পছন্দ করব না, কিন্তু সভ্যতার গতিপৃকৃতিই হচ্ছে মানুষ ধনের জন্য সুখের জন্য গ্রাম ছেড়ে নগরের পত্তন করেছে।
কোরিনের রাখাল চরিত্রটিও সরল নয়, কারণ সে নিজে তার খামারের মালিক নয়, মালিক যে সে খুব নচ্ছার টাইপের। তা হলে কোরিনের সুখটাও ধারিত সুখ। তা হলে, সুখের ব্যাখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে? গ্রামে গিয়ে এখন অনেকে খামার তৈরি করছে, বা গ্রামের লোকজনও খামার তৈরি করছে, কিন্তু তারা ধনবান হচ্ছে, কারণ একটা ব্যবসা তারা করছে, কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে গ্রামের লোক মাত্রই ধনবান হয়ে যাচ্ছে। তবে এ কথাটার সাথে সাথে একটা সুন্দর ছবির কথা বলতে হয়, সেটি হলো বাংলাদেশের গ্রাম আগের চেয়ে বহুগুণে সমৃদ্ধ হয়েছে অর্থনৈতিকভাবে। বাংলাদেশের কৃষির এবং কৃষিজাত দ্রব্যের ফলন এখন বহুগুণে সমৃদ্ধ। সে অর্থে বাংলাদেশ গ্রামীণ সমাজ এখন অনেক সুখী।
আর যারা মনে করেন সুখ শ্রেণি-গোত্র-গ্রাম-শহর নিরপেক্ষ, এমনকি সময়-নিরপেক্ষ তারা আসলে মানুষে জিনগত বৈশিষ্ট্যের কথা ভেবে কথাটা বলেন। আমার পেশাগত জীবনে অনেক সহকর্মী পেয়েছি যাঁরা চরিত্রগতভাবে যে কোন অবস্থায় সুখী ছিলেন, বা সুখ বোধ করতেন, কিংবা প্রদর্শন করতেন যে তাঁরা সুখে আছেন, আবার কিছু সহকর্মী দেখেছি, যাঁরা যে কোন অবস্থায় নিজেদেরকে অসুখী মনে করতেন। তবে বেশিরভাগ সহকর্মী ছিলেন, সুখ-দু:খের ব্যাপারের চেয়েও জীবন-যাপনকে গুরুত্ব দিতেন।
সুখের বোধ একটি জটিল চারিত্রিক প্রকরণ, বিশেষ করে ব্যক্তিগত সুখানুভূতি নির্ণয় করার ব্যাপারে। ডিকেন্সের গ্রেট ইক্সপেকটেশানস উপন্যাসের একটি চমৎকার চরিত্র হচ্ছে হার্বাট পকেট। সে সবসময় একটি আনন্দময় সুখের প্রতিচ্ছবি যেন। কোন মালিন্য নেই, কোন ক্লেদ নেই। ব্যবসা তার কোনটাই হচ্ছে না। কিন্তু তার সহাস্যচিত্ত সবসময় আনন্দদায়ক।
সুখানুভূতি আসলে যতটা না পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে তার চেয়ে বেশি মনে হয় নির্ভর করে চরিত্রের জিনগত বৈশিষ্ট্যের ওপর। সামান্য দু:খে কেউ কাতর হয়ে পড়ে, আর অসামান্য দু:খে কারো কারো মুখ থেকে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যের ছায়া অবসিত হয় না।
আসলে রুনা লাইলার গানটাই সত্য, ‘সুখ তুমি কী বল জানতে ইচ্ছে করে।’

=শেষ=

৫ সেপ্টেম্বর ২০২০।

সুখের বৃত্তান্ত
Comments (0)
Add Comment