শুদ্ধাচার হোক সবক্ষেত্রেই । হীরেন পণ্ডিত

0

সবাই চায় অনিয়ম ও দুর্নীতি দমন করা হোক। তবে আগে থেকেই যাতে এ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ করা যায়, সে বিষয়ে দুদকসহ সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় হওয়া উচিত। তাদের নজরদারি আরও কঠোর হওয়া দরকার। দুর্নীতি ও অনিয়মে যুক্ত ব্যক্তি যত প্রভাবশালীই হোক না কেন; কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না, সেটাই প্রত্যাশা।

ভালোমন্দের বিচারক্ষমতা দিয়ে যে বিবেক নির্ধারিত হয়, সে ব্যাপারে সবাই একমত তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ভিন্নমত থাকবে ভালোমন্দ আলাদা করা নিয়ে। অর্থাৎ কোনটা ভালো ও মন্দ সেটা নির্ধারণে মানুষের ভাবনায় বৈচিত্র থাকবে। এসব ভিন্নতা হতে পারে ব্যক্তি, সমাজ, এলাকা, সময়, ঘটনা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। বিবেকের কাজ হলো কোনো কিছুর ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা, সক্ষমতা-অক্ষমতা, নীতির কাছে সঁপে দিয়ে বর্তমানকে ভিত্তি ধরে ভবিষ্যৎ-ভাবনা বিচার করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানবসত্তাকে সহযোগিতা করা।

প্রত্যেকেই দেশের শান্তি, সবার মিলন, উজ্জ্বলতা, নীতি, সত্য ও সাফল্যের কথা বলে। এসব কথা শুনতেও পছন্দ করে। কাজের বেলায় এসবের তরে নিজেকে সঁপে দিতে চায় কিন্তু যখন দেখা যায়, অন্যের তুলনায় নিজের থলেটা তেমনভাবে পূর্ণ হচ্ছে না তখনই বিবেক হয়ে ওঠে হিংস্র। আর যে শান্তি কিংবা অন্য ইতিবাচকতার জন্য নিজেকে তুলে ধরা হয়, সেসব একটি অসুস্থ বিবেক এসে ঢেকে ফেলে। যেভাবে কালো মেঘ এসে আকাশের নীলকে অদৃশ্য করে দেয়।

ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও ৯ মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এই দীর্ঘ সংগ্রামের চালিকাশক্তি ছিল একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন। কিন্তু রাষ্ট্রের ৫০ বছরের ইতিহাসে সে স্বপ্ন বারবার বাধাগ্রস্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে।

১৯৭৪-এর ২৫ ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘‘একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না– চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কি না সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সকলকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।”

এদেশে আইনকানুন, নিয়মনীতি, পরিকল্পনা ও বিভিন্ন কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এসবের বাস্তবায়ন অব্যাহত আছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি, আইনকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগই যথেষ্ট নয়; এর জন্য সামগ্রিক এবং নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ প্রয়োজন।

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সামগ্রিক উদ্যোগের সহায়ক কৌশল হিসেবে ‘সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়: জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ প্রণয়ন করা হয়। এই কৌশলটি বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। চরিত্রনিষ্ঠা আনয়নের জন্য মানুষের জীবনের একেবারে শুরু অর্থাৎ পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে এগিয়ে চলছে সরকারের কার্যক্রম। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অপরাধী যত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠই হোক না কেন, ছাড় পাচ্ছে না। কারো ব্যক্তিগত অপরাধের দায় নিতে নারাজ সরকার ও দল। সরকারের এই কঠোর অবস্থান সুশীল সমাজসহ সব মহলে প্রশংসিত হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিগুলোতেও অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির প্রতিফলন রয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

করোনা সংকট শুরুর পর থেকে বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলার পাশাপাশি কঠোরভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতি দমনে জোর দেন তিনি। এসময়ে দুর্নীতির জন্য স্বাস্থ্যখাতের কজন হর্তাকর্তার বিরুদ্ধেও নানা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়। এছাড়া ত্রাণ তৎপরতায় যেসব জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায়, তাদেরও তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করে কঠোর বার্তা দেয় সরকার।

দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থান আগে থেকেই ছিল। বিশেষ করে নির্বাচনী ইশতেহারের ‘দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সচেষ্ট আছে সরকার। আগে থেকে চলে আসা সন্ত্রাস ও মাদকবিরোধী অভিযানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার রয়েছে।

সবাই চায় অনিয়ম ও দুর্নীতি দমন করা হোক। তবে আগে থেকেই যাতে এ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ করা যায়, সে বিষয়ে দুদকসহ সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় হওয়া উচিত। তাদের নজরদারি আরও কঠোর হওয়া দরকার। দুর্নীতি ও অনিয়মে যুক্ত ব্যক্তি যত প্রভাবশালীই হোক না কেন; কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না, সেটাই প্রত্যাশা।

দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সুশাসন খুব জরুরি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। দেশ যেখানে অবস্থান করছে, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা গেলে অতি দ্রুত সেই অবস্থান আরও অনেক উপরে উঠে যাবে এতে সন্দেহ নেই।

তবু বলতে গেলে দুর্নীতি ও অনিয়ম এখনও বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করা হলে এক সময় সব লজ্জা কাটিয়ে বাংলাদেশ উন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে এটা সবার বিশ্বাস। সরকার গত ১২ বছরে দেশের অনেক উন্নতি করেছে, এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু এটাও সত্য, গত ১০ বছরে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রশ্নে সরকারের ভাবমূর্তি ভালো হলেও আরও ভালো হওয়া প্রয়োজন ছিল।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগনের দুর্নীতিমুক্ত দেশের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখাবে এবং সেভাবেই দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকবে সেটাই সবার প্রত্যাশা। তবে জনগণের করের টাকায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গ্রহণ করে কীভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাট আর অপচয় করা হয়, তা আরও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রণিত হয়েছে। চারিত্রিক সাধুতা বা শুদ্ধতা অর্জন এবং দুর্নীতি দমনের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জাতীয় একটি কৌশল দলিল হিসেবে গৃহিত হয়েছে। যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক আইনকানুন ও বিধিবিধানের সুষ্ঠু প্রয়োগ, পদ্ধতিগত সংস্কার ও উন্নয়নসক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সবার চরিত্র নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহীতব্য কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছে।

সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্যে রূপকল্প ২০২১-এর সফল বাস্তবায়ন এবং ২০৩০-এর মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্র ও এর প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সমাজেও কার্যকরভাবে ন্যায় ও সততা প্রতিষ্ঠা আর প্রতিপালন জরুরি। সফলতার সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সমন্বিত সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন দরকার। নিশ্চয়ই সমাজ, রাষ্ট্র, ন্যায়নীতি ও স্বচ্ছতার নিরিখে এধরনের আর্থিক লেনদেন শুধু দুর্নীতি নয় বরং দুর্নীতির সূতিকাগার হিসেবে দানা বাঁধতে পারে।

এখন সবাই ব্যস্ত কে কতটা নিচে নামতে পারে সে প্রতিযোগিতায়। কী পরিমাণ নৈতিক স্খলন হচ্ছে তা কেউ ভেবে দেখে না। জীবনের দৌড়ে সবাই কে কাকে কীভাবে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে তা নিয়েই ব্যস্ত। বিবেকের স্খলন গুরুত্বপূর্ণ নয়। সম্পদশালী হওয়াই আসল।

সবাই প্রতিনিয়ত মানবীয় গুণাবলী বিসর্জন দিচ্ছে সম্পদ আহরণ আর ভোগবিলাসের জন্য। হারিয়ে যাচ্ছে নীতি-নৈতিকতা, লোপ পাচ্ছে ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা। মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

সবার মধ্যে এমন পশুপ্রবৃত্তি বাড়ছে কেন? এই যে সামাজিক অস্থিরতা চলছে এর শেষ কোথায়? শুধু আইনী কাঠামো দিয়ে এ অবক্ষয় দূর করা যাবে না। প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। প্রতিটা নাগরিককে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

বাঙালি উদার ও আবেগপ্রবণ জাতি। পরের উপকার করলে সে ধন্য হয়। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। শিক্ষার হার এত যে বাড়ছে তাতে কী লাভ হচ্ছে? শিক্ষিত হয়ে সবাই আরও বর্বরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। কোনো শিক্ষাই মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ববোধ তৈরিতে সহায়ক হচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সবাই ক্রমে আদিম যুগে ফিরে যাচ্ছে। ব্যাপারটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন। একবার খাদের কিনার থেকে ছিটকে নিচে পড়ে গেলে কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়ানো জাতির জন্য কঠিন হবে।

এমনসব কারণে সমাজে আদর্শনিষ্ঠ, সৎ, নীতিপরায়ণ, মেধাবী ও প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থায় মানবতাবোধ যেখানে বৃদ্ধি পাবার কথা সেখানে প্রতিনিয়ত কমছে। কিন্তু কেন? শিক্ষিত মানুষের মধ্যে মানবীয় গুণাবলী আরও বেশি থাকার কথা, তা এখন আর দেখা যাচ্ছেনা। কোথায় যাচ্ছি আমরা, কোথায় আমাদের মনুষ্যত্ববোধ?

লেখক: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.