স্টেম (STEM) শিক্ষা ২০৪১-এর রূপকল্প উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণকে গতিশীল করবে – মোঃ রেজুয়ান খান

0

সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যাথমেটিকস এ চারটি বিষয়ের আদ্যক্ষর মিলিয়ে সংক্ষেপে বলা হচ্ছেস্টেম (STEM)। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে শিক্ষার যে ধরনটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে,সেটি হলো স্টেম এডুকেশন। উন্নত দেশগুলো মনে করছে,ভবিষ্যতে তাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে স্টেম এডুকেশন অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। যেসব দেশ স্টেম এডুকেশনের ওপর জোর দিবে তারাই ভবিষ্যতে এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

স্টেম এডুকেশনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে,চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং একুশ শতকের জন্য সুশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলা।স্টেম শিক্ষা মানুষের মনের সৃজনশীলতাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের মধ্যে টিম ওয়ার্ক, উন্নত যোগাযোগ, কোনো কিছু খুঁজে বের করার দক্ষতা, কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার দক্ষতা, যেকোনো সমস্যার সমাধান করা, সর্বোপরি ডিজিটাল জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলাই হচ্ছে STEM-শিক্ষার মূল কাজ। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, এবং গণিত STEMশিক্ষার্থীদের সাফল্যের জন্য অনন্যভাবে উপযুক্ত। STEM শিক্ষা দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি করার জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।যে সমস্ত শিক্ষার্থী মানসম্পন্ন STEM শিক্ষা গ্রহণ করে, তারাই পরবর্তী প্রজন্মের উদ্ভাবক হয়ে ওঠে।STEM শিক্ষা প্রক্রিয়ায়শিক্ষার্থীরা শিখে, কিভাবে তাদের সময় পরিচালনা করতে হয় এবং কিভাবে বড়ো প্রকল্পগুলিকে ছোট ছোট ধাপে ভাগ করতে হয়। এটি এমন একটি পদ্ধতি, যা তাদের সারাজীবন উন্নতির জন্য সাহায্য করবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অভ কমার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টেম শিক্ষায় যারা শিক্ষিত তাদের জন্য প্রতি বছর ১৭ শতাংশ হারে কাজের সুযোগ বাড়ছে। আর অন্য ডিগ্রিধারীদের জন্য কর্মসংস্থান বাড়ছে প্রায় ১০ শতাংশ হারে।মানুষের মনে নানা জিজ্ঞাসা,কৌতূহল এবং অনুসন্ধান শুরু হয় মাধ্যমিক কাল থেকেই। শুধু পশ্চিমা দেশগুলোতেই নয়, ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোও তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় স্টেমকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দনীয় তৃতীয় শিক্ষায় সঠিক পথ বেছে নিতে পারে। বর্তমান যুগে বিজ্ঞান,গণিত ও প্রকৌশল ছাড়া সভ্যতা অচল। জীবন চলার পথে প্রতিটি স্তরে রয়েছে বিজ্ঞানের প্রভাব। মানবসভ্যতায় প্রযুক্তির ক্রম বিকাশ একটি জাতিকে বিকশিত করে।

স্টেম শিক্ষা একসময়কার সনাতনী নিয়মে পাঠ্যবই মুখস্থ করার প্রবণতাকে কমিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পাঠ্যবই মুখস্ত করার প্রবণতা এখনও লক্ষ্য করা যায়। স্টেম শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হলে, এর প্রভাব অনেকটা কমে আসবে। যেমন- আমাদের দেশের সকল বিভাগের শিক্ষার্থীদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে এখনকার শিক্ষার্থীরা আগেকার সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আধুনিক শিক্ষার সুফল ভোগ করতে পারছে। স্টেম শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সক্রিয় করে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। স্টেম সৃজনশীল সমস্যাগুলোর সমাধান করে। স্টেম অনুশীলনে শিক্ষার্থীদের নতুন কিছু জানার আগ্রহকে বাড়িয়ে দেয়। স্টেম শিক্ষা একজনের সাথে অন্যজনের যোগাযোগ দক্ষতাকে বাড়িয়ে তোলে। শিক্ষার্থীদের মনে আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ জোগায় এবং অতিমাত্রা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটি যৌক্তিক চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তিকে বাড়িয়ে তোলে।

বাংলাদেশের শিক্ষার মান আগের তুলনায় অধিকাংশে আধুনিকায়ন হয়েছে। ইনোভেশন কর্মসূচি, শিক্ষার নতুন নতুন প্রযুক্তি, গণমাধ্যমে শিক্ষা প্রদান কর্মসূচি, ডিজিটাল কন্টেন্ট প্রস্তুতকরণ এবং মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান পরিচালনা এর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের স্টেম নিয়ে পড়াশুনার আগ্রহকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে এসএসসি এবং এইচএসসি উভয় স্তরের জন্য বিজ্ঞান গ্রুপে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বছরের পর বছর কমে আসছিল। কারণ হিসেবে দেখা গেলো শিক্ষার্থীদের মাঝে বিজ্ঞান ও গণিত ভীতি। সরকার গণিত বিষয়কে শিক্ষার্থীদের মাঝে আরও আকর্ষণীয় করতে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পরিবেশ গড়ে তুলেছে। মেধাবি শিক্ষার্থীরা গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। প্রেক্ষিতেগণিতবিষয়েভালোগ্রেডপেতেগণিতশিক্ষারপ্রতিশিক্ষার্থীরাবেশিবেশি উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এভাবেগণিতেরপ্রতিবাংলাদেশেরশিক্ষার্থীদের ভীতি অনেকটা কমে এসেছে। শিক্ষার্থীদের চিন্তা ভাবনা বিকশিত হতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর নতুন উদ্ভাবনী শিক্ষা ব্যবস্থা সহায়তা করছে।

বাংলাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের কাছে স্টেম এডুকেশন খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। বাংলাদেশে ৪৩৯টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও ২১৬টি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে হাতে কলমে স্টেম শিক্ষা প্রদান করা হয়। এছাড়া, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (বিআইএসটি), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞঅন ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট অভ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (আইএসটি), সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অভ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (ঢাকা), বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অভ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, গোপালগঞ্জ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আহসানউল্ল্যাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিসিএন ইউনিভার্সিটি অভ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি কোটবাড়ি, কুমিল্লা, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অভ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি), চট্টগ্রাম, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট অভ সায়েন্স ট্রেড এন্ড টেকনোলজি (আইএসটিটি), ইউনিভার্সিটি অভ ইনফরমেশন টেকনোলজি এন্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা স্টেম শিক্ষা গ্রহণ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বিশেষ কৃতিত্ব দেখাচ্ছে।

বাংলাদেশ স্টেম ফাউন্ডেশন ২০২০ সালে সারাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে গবেষণাসমূলক কনসেপ্ট ও প্রজেক্ট আহ্বান করে। এ আহ্বানে শতাধিক টিমের মধ্যে ২৩৮টি প্রজেক্ট জমা পড়ে। ২০৩০ সালের ১৭টি গোলের মধ্যে ১৩টি গোল বা লক্ষ্যমাত্রাকে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছিল ন্যাশনাল স্টেম কম্পিটিশন। শিক্ষার্থীরাদলগতভাবেক্ষুধা, দারিদ্র্য, পয়ঃনিষ্কাশন, বিশুদ্ধ পানির অভাব, জলবায়ু সমস্যা সমাধান, শিল্পায়ন, পরিকল্পিত নগরায়ণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে করণীয় ইত্যাদি বিষয়ক কনসেপ্ট পেপার ও প্রজেক্ট উপস্থাপন করে। বিজ্ঞানভিত্তিক আইডিয়াসহ প্রজেক্ট জমাদানকারীদের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে বিজয়ী দল বুয়েট টিম, প্রথম রানার আপ রুয়েট টিম এবং দ্বিতীয় রানার আপ অর্জন করে চুয়েট টিম। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা স্টেম প্রতিযোগিতায় সফলতার স্বাক্ষর রাখছে।

স্টেম শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলতে ‘ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ’ নামের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ আকর্ষণীয় রোবটিক্স প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। বিশ্বেরবিভিন্নদেশেরশিক্ষার্থীরা এ প্রতিযোগিতায়অংশনেয়। ২০১৭ সালথেকে এ প্রতিযোগিতায়বাংলাদেশও অংশ নিয়ে আসছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ রোবটিক্স অলিম্পিকে সপ্তম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এবারই অতিমারি করোনাভাইরাসের কারণে ফার্স্ট গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ শীর্ষক প্রতিযোগিতাটি অনলাইন প্লাটফর্মে অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো এ রোবটিক্স প্রতিযোগিতায় এবার বাংলাদেশসহ ১৭৩টি দেশ অংশগ্রহণ করে। আনন্দের বিষয় হলো বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রোবোটিক্সির অলিম্পিক হিসেবে খ্যাত আন্তর্জাতিক এ খেলায় ১৭৩টি দেশের নামকরা সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করে। বিশ্ব জনপ্রিয় এ রোবটিক্স অলিম্পিকে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব সাফল্য বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের অবস্থানকে অনেক ঊর্ধ্বে দাঁড় করিয়েছে। সাবাস! বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আধুনিক প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে বাংলাদেশে স্টেম এডুকেশনকে অগ্রাধিকার বিবেচনা করা হচ্ছে। এর ফলে আগের তুলনায় এখনকার শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষায়পারদর্শী হয়ে ওঠছে। STEM শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আবিষ্কারক ও উদ্ভাবক হয়ে উঠতে পারছে। STEM ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করে শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (4IR)-এর নেতৃত্ব প্রদানকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। নিঃসন্দেহে বলা যায়,STEM শিক্ষা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১-এ উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে বাস্তব রূপ দিতে আরও গতিশীল করবে।

লেখক : তথ্য অফিসার, পিআইডি।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.