বীরাঙ্গনা সখিনা – বীরত্ব আর প্রেমের অমর কাব্য

0

মো. হুমায়ুন কবির, গৌরীপুর : বীরাঙ্গনা সখিনার বীরত্বের কথা আমাদের অনেকেরই জানা। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মওহা ইউনিয়নের কুমড়ী গ্রাম। সপ্তদশ শতকে এই গ্রামের নাম ছিল কেল্লা তাজপুর।বার ভূঁইয়ার অন্যতম কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ির স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁর দোহিত্র ফিরোজ খাঁ আর কেল্লা তাজপুরের মোগল দেওয়ান উমর খাঁর কন্যা সখিনা বিবির স্মৃতিময় এই গ্রাম। এই গ্রামেরই কুমড়ী নামক স্থানে সুনসান নীরবতায় প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন পতিপ্রাণা বীরাঙ্গনা সখিনা।ইতিহাসখ্যাত এই সমাধি বর্তমান প্রজন্মের কাছে সখিনা বিবির মাজার নামে সুপরিচিত।

অন্তঃপুরবাসিনী জমিদার কন্যা সখিনার বীরাঙ্গনা হয়ে ওঠার কাহিনীটি বেশ চমকপ্রদ ও হৃদয় বিদারক। কেল্লাতাজপুরের মোঘল দেওয়ান উমর খাঁর কন্যা সখিনা ছিলেন অপরূপ রপবতী ও সর্ববিদ্যায় পারদর্শী। তার এই রূপ ও গুণের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের অঞ্চলে।এমনকি তা ৫০/৬০ মাইল দূরবর্তী বার ভূঁইয়ার অন্যতম কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ির স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁর দোহিত্র ফিরোজ খাঁর কান পর্যন্ত পৌঁছায়। সখিনার রূপ-গুণের সুখ্যাতি শোনার পর থেকে অপরূপ রূপবতী সখিনাকে এক নজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে ফিরোজ খাঁর হৃদয়। কিন্তু দেওয়ান উমর খাঁ পরিবারের কঠোর পর্দাপ্রথা ফিরোজের ভালোবাসার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ভেবেচিন্তে সখিনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে কৌশলের আশ্রয় নেয় ফিরোজ খাঁ। দরিয়া নামে এক সুন্দরী বাদীকে তসবি বিক্রেতা সাজিয়ে উমর খাঁর অন্তঃপুরে সখিনার কাছে পাঠানো হয়। দরিয়ার মুখে ফিরোজ খাঁর অসামান্য বীরত্ব ও রূপ-গুণের প্রশংসা শুনে সদ্য যৌবনপ্রাপ্তা সখিনা নিজের অজান্তেই ফিরোজকে মনে মনে ভালবেসে ফেলে। চপলমতি কন্যার হঠাৎ ম্রীয়মানা হওয়ার অন্তনির্হিত কারণ বুঝতে বাকি থাকে না সখিনার খাস বাদীর। সেও সহোযোগিতার বাড়িয়ে দেয়।

প্রেমাণলে দগ্ধ ফিরোজ খাঁ জঙ্গলবাড়িতে এসে মা ফিরোজার সম্মতি নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় উমর খাঁর দরবারে। কিন্তু আভিজাত্য গৌরবে গর্বিত উমর খাঁ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। অবশ্য, প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অন্য কারণও আছে। ওমর খাঁ ছিলেন দিল্লীর মোগল সম্রাটের অনুগত আর ফিরোজ খাঁ বংশানুক্রমে মোগলদের শত্রু। তাছাড়া উমর খাঁ ঘৃণাভরে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, ফিরোজের নানা ঈশা খাঁ বিধর্মীকে (সোনা বিবি) বিয়ে করেছিলেন। লজ্জা-ঘৃণা ক্ষোভে প্রত্যাখ্যাত ফিরোজ খাঁ বিশাল বাহিনী নিয়ে কেল্লাতাজপুর আক্রমণ করে। অতর্কিত আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পরাজয় বরণ করে। শত্রুপক্ষের বিজয়ে উমর খাঁর অন্তঃপুর নারীশূন্য হলেও সখিনার ভাবান্তর হয় না। তিনি ঠাঁয় বসে থাকেন। বিজয়ী ফিরোজ খাঁ অন্তঃপুরে ঢুকে তাকে বাহুবন্দি করে জঙ্গলবাড়ী নিয়ে যাবেন এমনটিই যেন চাওয়া ছিল সখিনার। হলও তাই। ইচ্ছার টানে, অনিচ্ছার ভানে সখিনা ফিরোজ খাঁর হাত ধরে জঙ্গলবাড়ি যান। বিয়ের মধ্যদিয়ে উভয়ের অতৃপ্ত প্রেম পূর্ণতা পায়।

বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধিতে প্রকৃতির নিঃশব্দ নৈবেদ্য। এদিকে,পরাজিত উমর খাঁ প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে হাজির হন দিল্লীর শাহানশাহ জাহাঙ্গীরের নিকট। চরম মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে উমর খাঁ শাহানশাহকে বলেন, বিধর্মী ফিরোজ অতর্কিত তার রাজ্য আক্রমণ করে জোর করে তার কন্যা সখিনাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। খাজনা পরিশোধ না করায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের পূর্ব থেকেই প্রচন্ড ক্ষোভ ছিল ফিরোজ খাঁর ওপর। আর তাই প্রচুরসংখ্যক সৈন্য, হাতি, ঘোড়া সাথে দিয়ে উমর খাঁকে পাঠিয়ে দিলেন জঙ্গলবাড়ি দখল করতে। উমর খাঁর আগমনের খবর পেয়ে বীর যোদ্ধা ফিরোজ দীর্ঘ পথ সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বাধা দিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের বাহিনীকে। দু’দিন দু’রাত একটানা যুদ্ধ করে সংখ্যা ও শক্তিতে অধিক উমর খাঁর কাছে পরাজিত হয়ে বন্দি হন ফিরোজ । এরপর সখিনাকে তালাক দেয়ার জন্য ফিরোজ খাঁর ওপর চাপ প্রয়োগ করেন উমর খাঁ।কিন্তু ফিরোজের সাফ কথা জীবন থাকতে সখিনার প্রেমের অমর্যাদা করে স্বার্থপরের মতো রাজ্যভোগ করবেন না।

স্বামীর বন্দি হওয়ার খবর যখন সখিনার কাছে পৌঁছে তখন তিনি একটুও বিচলিত না হয়ে পুরুষ বেশ ধারণ করেন এবং চারদিকে রটিয়ে দেন যে, ফিরোজ খাঁর মামাতো ভাই সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। অতঃপর সখিনা শাশুড়ি তথা ফিরোজের মাকে সালাম করে আপন পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রকৃতির নিবিড় মমতায় চিরনিদ্রায় বীরাঙ্গনা সখিনা। যুদ্ধের ময়দানে হঠাৎ আবির্ভুত হয় সতের-আঠারো বছর বয়েসী এক অনিন্দ্যকান্তি যুবক। তার হাতের ছটায় যেন বিদ্যুৎ চমকায়। যুবকের নেতৃত্বে ফিরোজের বিপর্যস্থ বাহিনী পুনরায় ঘুরে দাঁড়ায়। ক্ষ্যাপা নেকড়ের মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রু সৈন্যর ওপর। সমন্বিত আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী যখন বিপন্নপ্রায়, এমন সময় ঘটল সেই নিন্দনীয় ঘটনা যা ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। উমর খাঁর জনৈক উজিরের কুমন্ত্রণায় রটিয়ে দেয়া হল-যাকে উপলক্ষ্য করে এই যুদ্ধ, সেই সখিনাকে তালাক দিয়েছেন তার স্বামী ফিরোজ খাঁ। আলামত হিসেবে ফিরোজের সই জাল করে দেখানো হল যুদ্ধক্ষেত্রে।

মুহূর্তের মধ্যেই পাল্টে যায় যুদ্ধের দৃশ্যপট।এতক্ষণ যে যুবক সেনাপতির হাতে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল সে হাত মুহূর্তের মধ্যেই স্থবির হয়ে যায়।ঘোড়ার উপর থেকে আস্তে আস্তে তার নিথর দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ভুলুণ্ঠিত সেনাপতির শিরোস্ত্রাণ খসে বেরিয়ে আসে তার অপূর্ব মেঘবরণ কেশ। উপস্থিত সবাই দেখল, এতক্ষণ যে তরুণ সেনাপতি অভূতপূর্ব রণকৌশলে যুদ্ধ করছিল সে আর কেউ নয়, উমর খাঁর আদুরের দুলালী সখিনা। খবর পেয়ে ছুটে আসেন পিতা উমর খাঁ। কলিজার টুকরো কন্যার প্রাণহীন দেহ কোলে নিয়ে উন্মাদের মতো বিলাপ করতে থাকেন। সে কান্নায় জঙ্গলবাড়ীর বাতাস সেদিন কতটা ভারী হয়ে উঠেছিল তা জানা যায়নি, তবে এই কাহিনী শুনে পূর্ববাসীর অন্তর আজো করুণ রসে সিক্ত হয়ে ওঠে। গাল বেয়ে নেমে আসে নোনা জলের স্রোত।

এ ঘটনার পর শোকে মুহ্যমান উমর খাঁ জামাতা ফিরোজ খাঁকে মুক্ত করে দেন। বন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে ফিরোজ বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। প্রিয়তমার বিয়োগব্যাথা তাকে কিছুতেই সুস্থ হতে দেয় না। অগত্যা রাজপাট চুকিয়ে একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করেন তিনি। এরপর কেল্লা তাজপুরবাসী দেখে প্রতিদিন সন্ধ্যায় এক সোম্যকান্তি মৌণি সন্যাসী সখিনার সমাধিতে প্রদীপ জ্বেলে নিশ্চুপ বসে থাকেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে আঁধার নামে, নিশুতি রাতের নৈঃশব্দ গ্রাস করে চরাচর; তথাপিও সেই আনমনা সন্যাসী স্থিরনেত্রে চেয়ে থাকেন সমাধির দিকে ।এমনি করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পরম মমতায় ফিরোজ আগলে রেখেছিলেন তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কবর।

কিভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি গৌরীপুরে যাওয়া যায়। এছাড়া ঢাকা থেকে সড়ক পথে ময়মনসিংহে আসতে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে এনা, শামীম এন্টারপ্রাইজ, সৌখিনসহ কয়েকটি পরিবহনের বাস রয়েছে। এনা ট্রান্সর্পোটে ভাড়া জনপ্রতি ২২০ টাকা, সৌখিন পরবিহনে ১৫০ টাকা। ময়মনসিংহ এসে ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের কাছের বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস কিংবা সিএনজিযোগে গৌরীপুর আসতে পারেন। ময়মনসিংহ থেকে লোকাল বাসের ভাড়া ২৫ টাকা। গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ১০০-১৫০ টাকায় সিএনজি রিজার্ভ করে কুমড়ী গ্রামে যাওয়া যায়। এ ছাড়া গৌরীপুর থেকে ভুটিয়ারকোনা বাজারে টেম্পো বা ইজিবাইকে আসতে পারেন। ভাড়া ১০-১৫ টাকা। এরপর ১০ থেকে ১৫ টাকায় রিকশায় কুমড়ী গ্রামে।

ঢাকা থেকে ট্রেন করেও যেতে পারেন। ঢাকা থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস দুপুর দুইটা বিশ মিনিটে এবং হাওড় এক্সপ্রেস রাত এগারোটা পনেরো মিনিটে মোহনগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছাড়ে। ভাড়া শ্রেণিভেদে ১০০ থেকে ৩৬০ টাকা। ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের কাছের বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস কিংবা সিএনজিযোগে যাওয়া যাবে বিবি সখিনার সমাধিস্থলে।

কোথায় থাকবেন : কুমড়ী গ্রামে রাত্রী যাপনের কোন ব্যবস্থা নেই। থাকার জন্য আপনাকে আসতে হবে গৌরীপুর। এখানে শাপলা প্লাজায় রাজগৌরীপুর আবাসিক হোটেল আছে। আর না হলে চলে আসতে হবে ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে রয়েছে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল। উল্লখেযোগ্য কয়েকটি হলো আমির ইন্টান্যাশনাল (০১৭১১১৬৭ ৯৪৮), হোটেল মুস্তাফিজ ইন্টারন্যাশলনাল (০১৭১৫১৩৩ ৫০৭), হোটেল হেরা (০১৭১১১৬৭ ৮৮০) হোটেল সিলভার ক্যাসল (০৯১৬৬১৫০, ০১৭১০৮৫৭ ০৫৪), হোটেল খাঁন ইন্টারন্যাশনাল (০৯১৬৫৯৯৫) ইত্যাদি।

কোথায় খাবেন : খাবারের জন্য গৌরীপুর শহরে পাবেন বেশ কিছু খাবার হোটেল। ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থল প্রেস ক্লাব ক্যান্টিনের মোরগ পোলাওয়ের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। হোটেল সারিন্দা ও হোটেল ধানসিঁড়িও ভালো। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে মাঝারি ও নিম্নমানের বেশ কিছু খাবার হোটেল। (তথ্যসূত্রঃ ১. গৌরীপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য ও কিংবদন্তী গ্রন্থ, লেখক-অধ্যাপক কাজী এম.এ মোনায়েম, ২. অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ন সচিব ইফতেখার আহামেদ, লেখক রণজিৎ করের গ্রন্থনা ও সম্পাদনায় বীরাঙ্গণা সখিনার কাহিনী।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.