অবিভক্ত বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ

0

পাবনা প্রতিনিধি : ১২২ বছরে এসে দাঁড়িয়েছে উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ। অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলায় প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের পাবনা জেলার একটি ঐতিহাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৮৯৮ সালে শ্রী গোপালচন্দ্র লাহিড়ী কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ছায়াঘেরা সুবিশাল ক্যাম্পাসের এডওয়ার্ড কলেজে লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড দেশজুড়ে আলোচিত ছিল।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৮২৮ সালে পাবনা জেলার ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারিত হওয়ার পর এ অঞ্চলে শিক্ষা প্রসারের কথা চিন্তা করা হয়। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে শ্রী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী পাবনায় প্রথমে ‘পাবনা ইনস্টিটিউশন’ (বর্তমান গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউট) নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ১৮৯৮ সালে এ বিদ্যালয়ের একটি কক্ষেই গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী এডওয়ার্ড কলেজের কার্যক্রম শুরু করেন। একই বছর ডিসেম্বরে এফ.এ স্ট্যান্ডার্ড কলেজ নামে কলেজটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। প্রথমদিকে কলেজটি মাত্র ২৬ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী ১৯০৬ সাল পর্যন্ত কলেজটির অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং সেসময় এর নাম পরিবর্তন করে পাবনা কলেজ নামকরণ করা হয়।

সূত্র জানায়, ১৯১১ সালে কলেজটির নাম পরিবর্তন করে পুনরায় ভারতের তৎকালীন সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের নামানুসারে এডওয়ার্ড কলেজ করা হয়। কলেজটি প্রতিষ্ঠার সময় ও প্রথমদিকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন তাড়াশের জমিদার রায় বনমালী রায় বাহাদুর, কুষ্টিয়ার আমলা সদরপুরের জমিদারসহ অন্যান্যরা। ১৯১৫-১৬ সালের মধ্যে প্রাথমিক অবকাঠামো বা অট্টালিকা নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পর, ১৯৬১ সালে কলেজের মোট জমির পরিমান দাঁড়ায় ৪৯ একর। ১৯৬৮ সালের পহেলা মার্চ এডওয়ার্ড কলেজকে সরকারি করা হয়। কলেজের বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২২ হাজারের মতো। ১৯২১ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকার সময় ৫টি বিষয়ে পাঠদানের অনুমতি দেয়া হয়। প্রথমদিকে পাঠদানের বিষয়গুলো ছিল ইংরেজি, ইতিহাস, যুক্তিবিদ্যা, গণিত, বিজ্ঞান, সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি।

জানা যায়, ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বিএসসি কোর্স, ১৯৪০-এ বিএ কোর্স, ১৯৪৬-এ কলেজে বায়োলজি বিভাগ, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ও পরের বছর অর্থনীতিতে অনার্স, ১৯৭২-এ পদার্থ বিজ্ঞান, গণিত ও ব্যবস্থাপনায় অনার্স কোর্স, পরের বছর বাংলা ও অর্থনীতিতে এমএ কোর্স, ১৯৮৭ তে ইংরেজি, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, হিসাববিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন ও ইতিহাস বিষয়ে অনার্স কোর্স, পরবর্তীতে এ বিষয়গুলোতে ১৯৯৫ সালে মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়। ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স, পরের বছর প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স ও ২০১১ সালে ফিন্যান্স ও মার্কেটিং বিষয়ে অনার্স কোর্সে পাঠদান শুরু হয়।

১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি, রসায়ন, উদ্ভিদবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, রাষ্টবিজ্ঞান, দর্শন ও ইতিহাস বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়। এতে অনার্স কোর্স চালু বিষয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২টিতে। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে এ ১২টি বিষয়েই মাস্টার্স কোর্স চালু হয়। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে পাঠদান শুরু হয়। এর পরের বছর প্রাণিবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স শুরু হয়।
২০১১ খ্রিস্টাব্দে মার্কেটিং ও ফিন্যান্স বিষয়ে অনার্স কোর্সে পাঠদান শুরু হয়েছে। ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে মাধ্যমিক শ্রেণি বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে শিক্ষা মন্ত্রাণালয় পুনরায় এ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট কোর্স খোলার জন্য নির্দেশ দেয় এবং এর প্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, রাজশাহী, উচ্চ মাধ্যমিক শাখা খোলার প্রয়োজনীয় অনুমতি প্রদান করে। ফলে ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসা শিক্ষা শাখা মোট ৬০০ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি করার মধ্য দিয়ে পুনরায় উচ্চ মাধ্যমিক পাঠদান শুরু হয়। বর্তমানে এ কলেজে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। বিশ শতকের গোধূলি বেলায় এডওয়ার্ড কলেজ শতবর্ষের গৌরবদীপ্ত পথ পরিক্রমা সম্পন্ন করে।

কলেজ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে কলেজটি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে। সরকারি কলেজগুলোর মধ্যে এ প্লাস ক্যাটাগরিভুক্ত হয়েছে। ২০১০-২০১১ অর্থবছরে জেলা শহরে অবস্থিত ৬৯টি সরকারি কলেজ উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্তও হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৪ তলা বিশিষ্ট একাডেমিক কাম এক্সামিনেশন সেন্টারের নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। কলেজের বিভিন্ন বিভাগে মোট ১৬০টি পদ সৃষ্টি হয়েছে এবং আরও কিছু পদ সৃষ্টির কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। বর্তমানে কলেজে একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনসহ দুইটি ছাত্রীনিবাস ও তিনটি ছাত্রাবাস, একটি ক্যাফেটেরিয়া, আধুনিক বিজ্ঞানাগার, কয়েকটি খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, অডিটোরিয়াম এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্থাপনা বিদ্যমান। বর্তমানে কলেজের আর্থিক লেনদেন অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে এবং সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ডিএলার্ট চালুর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভারতের সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড। তার মাতা রাণী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। রাজ্যে অভিষেককালে তিনি ‘গ্রেড ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ড এবং ব্রিটিশ উপনিবেশসমূহের রাজা এবং ভারতবর্ষের সম্রাট উপাধি গ্রহণ করেন। সপ্তম এডওয়ার্ড দয়ালু, প্রজাবৎসল, বিচক্ষণ ‘শান্তি-সংস্থাপক’ হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তার শাসনামলের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্টে ‘শিক্ষা আইন’ প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষা পদ্ধতির আধুনিকীকরণ করা। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের মৃত্যু হলে তার পুণ্যস্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে পাবনা কলেজের নামকরণ করা হলো ‘এডওয়ার্ড কলেজ’। একজন সম্রাট নামে কলেজের নামকরণ উপমহাদেশে এটিই প্রথম।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.