পদ্মা সেতু ফেরাবে বাংলার শস্য ভান্ডারের সুনাম

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : মুঘল আমল থেকে বরিশালকে বলা হতো “বাংলার শস্য ভান্ডার”। মাটির উর্বরতা আর অনুকূল পরিবেশের কারণে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের শস্যের কদর ছিলো দেশ পেরিয়ে বিদেশে। দিনে দিনে সেই ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে বরিশাল।

এর মূল কারণ ছিলো প্রমত্তা পদ্মা নদী। এ নদীর সবধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীকে। কারণ পদ্মা নদী পার হতে গিয়ে ফেরির যানজটের কারণে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে গিয়ে ট্রাক বোঝাই উৎপাদিত কাঁচা পন্য সঠিক সময়ে ঢাকার পাইকারী আড়তে পৌছানো সম্ভব হয়নি। এ কারণে ট্রাকেই পচে নস্ট হয়ে যেতো এসব কাঁচা পন্য। ফলে কৃষকের ঘাম ঝড়ানো কস্টে উৎপাদিত পণ্যের বাজার না পাওয়ায় দিন দিন কৃষকরা সবধরনের শষ্য উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্য হারানোর শষ্য ভান্ডারের সেই গ্লানি এবার মুছে ফেলার সুযোগ এনে দিয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে এবার হারিয়ে যাওয়া কৃষির সমৃদ্ধি পুনরুদ্ধার হবে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা। বরিশালের কৃতি সন্তান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার বলেন, উন্নয়নের প্রধাান শর্ত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমাদের সমস্যা ছিল ফেরিঘাটে শস্য পচে যেতো। এখন ফেরিও নেই। ফলে দক্ষিণাঞ্চল তার শস্য ভান্ডার ফিরে পেতে আরকোনো বাঁধা রইল না। তিনি আরও বলেন, দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে নিজেদের অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে শুধু বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে। তার (প্রধানমন্ত্রী) হাত ধরেই এ দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং আগামীতে এভাবেই এগিয়ে যাবে আরও বহুদূর। আমাদের মনে রাখতে হবে দেশের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু কন্যাই হচ্ছেন আমাদের একমাত্র ভরসার স্থল।

কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৭ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ লাখ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৩১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন। যা পূর্বের বছরের তুলনায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন বেশি। শুধু চাল নয়; প্রতিবছর শস্যেরও বাম্পার ফলন হতো। তবে তা হাতেগোনা কয়েকটি শস্য উৎপাদনে সীমাবদ্ধ ছিল। এর বড় কারণ ছিলো চাষিদের অনাগ্রহ।

কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশালের গৌরনদী উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষিবিদ মোঃ মামুনুর রহমান বলেন, দেশের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকার সাথে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে পদ্মা সেতু। এতে পূর্বে যেখানে পণ্য পরিবহনে সাত থেকে ১৫ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় লাগতো, এখন সেখানে সময় খরচ হচ্ছে মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা। এতে করে সঠিক সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য ঢাকার ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে যাবে। ফলে কৃষক লোকসানের মুখে পড়বে না।

তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে পুরো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় সমৃদ্ধি আসবে। বিশেষ করে কৃষিখাতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আসবে দক্ষিণাঞ্চলে। যে কারণে আমি মনে করছি বাংলার শস্য ভান্ডার বরিশাল তার হারিয়ে যাওয়া সমৃদ্ধি ফিরে পাবে।

কৃষকরাও মনে করেন কৃষির সুদিন ফেরাবে পদ্মা সেতু। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলা সদরের কৃষক স¤্রাট আকন বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দ্রুত ঢাকায় সবধরনের উৎপাদিত পন্য পরিবহনযোগে পাঠানো যাচ্ছে এটাই বড় লাভ। আগৈলঝাড়া উপজেলার রত্মপুর গ্রামের পানচাষি রতন ঘরামী বলেন, এমনও দিন গেছে পাইকারের অভাবে বরজে পান পচে নস্ট হয়ে গেছে। এখন পাইকার না আসলে পরিবহনে পদ্মা সেতু পাড় হয়ে নিজে গিয়ে কারওয়ান বাজারে বিক্রি করে আসবো।

পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার তরমুজ চাষী ওবায়েদুল হক বলেন, প্রতিবছর তরমুজের বাম্পার ফলন হলেও পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে চাষীরা দাম পেতাম না। অথচ কেজি দরে বাজারে উচ্চমূল্যে তরমুজ বিক্রি হতো। এখন আর মাঝখানের (দালাল) কাউকে প্রয়োজন হবে না। বরিশাল পছন্দ না হলে ঢাকায় নিয়ে যাব তরমুজ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের খামারবাড়ি বরিশালের উপ-পরিচালক হারুন-অর রশিদ বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিতে যে সম্প্রসারণ সৃষ্টি হবে তা অভাবনীয়। একদিকে কৃষক যেমন ন্যায্যমূল্য পাবেন, অন্যদিকে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়বে। আগে ক্রেতা সংকটে যেসব শস্য উৎপাদন হতো না অথচ বাজারে উচ্চমূল্যে তার চাহিদা ছিল, সেগুলো এখন থেকে আবাদ হবে। কৃষকের রক্ত চুষে কেউ খেতে পারবে না। কারণ দালাল, ফরিয়া, ব্যাপারীদের এখন আর প্রয়োজন হবে না। কৃষক তার ক্ষেত থেকে শস্য উত্তোলন করে সরাসরি ঢাকায় নিয়ে যেতে পারবেন। আর তাজা শস্য সরবরাহ করে ভালো দাম পাবেন। কৃষকরা পরিবহনযোগে ভোরে রওয়ানা দিয়ে পদ্মা সেতু পাড় হয়ে ঢাকায় গিয়ে তার পণ্য বিক্রি করে আবার রাতে এসে বাড়িতে ঘুমাতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, যেহেতু দক্ষিণাঞ্চলের মাটি খুবই উর্বর। তাই এখানে সবধরনের শস্য উৎপাদিত হয়। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে।

হারুন-অর রশিদ বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের উৎপাদিত তরমুজ, পেয়ারা, আমড়া, মালটা, সবজি বিক্রির জন্য আর কোনো মধ্যস্বত্বভোগীর অপেক্ষায় থাকতে হবে না। পচনের ভয়ে তরমুজ এখন আর অল্প দামে বিক্রি করতে হবে না। দিনে ক্ষেত থেকে যা তুলবেন তা নিয়ে কৃষক সরাসরি দেশের বড় বড় বাজারে চলে যেতে পারবেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিবিপ্লব সূচিত হওয়ার পাশাপাশি বাংলার শস্য ভান্ডার বরিশাল বিভাগ তার পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবু সৈয়দ মোঃ জোবায়েদুল আলম বলেন, উপকূলের মধ্যে সম্পূর্ণ কৃষি অঞ্চল বরগুনায় আগে আমন চাষের পর জমি পতিত থাকতো। কিন্ত এখন রবি শস্য উৎপাদন বাড়াবেন কৃষকরা। কারণ কাঁচা শস্যের বাজার বা ভালো দাম পাওয়া নির্ভর করে এর সহজলভ্যতার ওপর। এই পণ্য যত দ্রুত ক্রেতার হাতে পৌঁছানো যাবে ততো ভালো দাম পাওয়া যাবে। এখন পদ্মা সেতুর কারণে এই কাজটি সহজে করতে পারবেন কৃষকরা। আগে দেখা যেতো অনেক শস্যের ফলন ভালো হতো কিন্তু ঢাকা থেকে পাইকার আসার অপেক্ষায় থেকে চাষি আগ্রহ হারাতেন। এখন আর সেই পরনির্ভর হতে হবেনা।

তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে উচ্চমূল্যের শস্য যেমন তরমুজ নিয়ে শঙ্কা কেটে গেছে চাষিদের। তাছাড়া শুধু বরগুনায় নয়, দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও এখন আর অনাবাদি জমি থাকবে না। আগে আমাদের ফসলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হলেও অনেকগুলো পূরণ হতোনা। এখন সেই সুযোগ নেই। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগেই বিদেশী ফল ড্রাগনের অসংখ্য বাগান হয়েছে এই অঞ্চলে।

বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আতিকুর রহমান আতিক বলেন, বহুল কাঙ্খিত পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষ দেশের সকল প্রান্তের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ও জীবনমানে ইতিবাচক প্রভাব পরবে। পদ্মা সেতুর প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হবে। এ অঞ্চলের মানুষ পরিকল্পিত জনসম্পদে রূপান্তরিত হবে। কর্মসংস্থান ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ আবদান রাখবে। যা এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানকে উন্নতির দিকে ধাবিত করবে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে আগামীতে দক্ষিণাঞ্চল হবে অন্যতম বাণিজ্যিক ও শিল্পনগরী।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.