ব্রিটিশ সাংবাদিকের চোখে বাংলাদেশের ‘অলৌকিক’ সাফল্যের রহস্য

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশ এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়া সেখানে ছিল ১৯৭৫ সালে। দক্ষিণ কোরিয়ার তখনকার সেই উন্নতিকে ‘অলৌকিক’ বলে মনে করা হতো, বাংলাদেশের এখনকার সাফল্যকেও সেভাবেই দেখা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশের এ বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার পেছনের রহস্য উন্মোচন করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ও অর্থনীতিবিদ ডেভিড পিলিং।

এমন একটা দেশের নাম বলুন, যার মাথাপিছু আয় ৫০০ ডলারের কম। নারীদের গড়ে ৪ দশমিক ৫ জন সন্তান। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে ৪৪ শতাংশ মানুষ। সেই দেশটি বাংলাদেশ। তবে সেটা ১৯৯০ সালের।

৩২ বছর পর আজ সেই দেশটির রূপান্তর ঘটে গেছে। মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে আট গুণ। নারীদের গড়ে দুটি সন্তান। প্রত্যেক সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য পিতা-মাতার হাতে অর্থ রয়েছে; শিল্প খাতে বিনিয়োগ করার জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে আছে প্রচুর সঞ্চয় বা অর্থ। দারিদ্র্যের হার ৪৪ শতাংশ থেকে অর্ধেকে নেমে এসেছে।

নারীর অবস্থানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি। ১৯৭১ সালে দেশটি যখন স্বাধীন হয়, তখন প্রতি পাঁচজনে একজন শিশু পাঁচ বছর বয়সের আগেই মারা যেত। এখন সেই সংখ্যা ৩০ জনে ১।

বাংলাদেশের এই সাফল্যের গল্প নিয়ে প্রভাবশালী ডেভিড পিলিং প্রতিবেদনটি লিখেছেন। তিনি যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী এ দৈনিকটির আফ্রিকা অঞ্চলের সম্পাদক এবং উন্নয়নবিষয়ক অর্থনীতিবিদ।

ডেভিড পিলিং আরও লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ এখনও দরিদ্র বটে। এ কথাও ঠিক যে দেশটি রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরিবেশগত বিপদ এবং উচ্চস্তরের দুর্নীতির সঙ্গে লড়াই করছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে গত সপ্তাহে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ঋণ চেয়েছে। কিন্তু আপনি যদি বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করেন, তাহলে আপনাকে বলতেই হবে-একদা হেনরি কিসিঞ্জার যে দেশটিকে “তলাবিহীন ঝুড়ি” বলে তাচ্ছিল্য করেছিলেন, সেই দেশটিই এখন উন্নয়নের একটি সাফল্য হিসেবে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।’

ডেভিড পিলিংয়ের মতে, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কাছ থেকে আফ্রিকার অনেক দেশ শিক্ষা নিতে পারে, যদিও বাংলাদেশকে উন্নয়নের একটি ‘মডেল’ বা ‘টেমপ্লেট ‘ হিসেবে খুব কমই উল্লেখ করা হয়েছে, যতটা দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরকে উল্লেখ করা হয়। তবে আফ্রিকার কোনো দেশ তাদের সাফল্যের কাছাকাছি আসেনি।

ডেভিড পিলিং লিখেছেন, বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। অতীতের জাতীয় কর্মকাণ্ডকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার পথপ্রদর্শক হিসেবে দেখেছে। সেই সঙ্গে যারা বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিল, তাদের জন্য এটি একটি তিরস্কার। স্বাধীন দ্রুত দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড দেখেছে। তার পরও সেই খারাপ শুরু থেকেও সাফল্যের পথে অগ্রসর হচ্ছে।

বাংলাদেশের এই এগিয়ে চলা বা সাফল্যের তিনটি কারণ খুঁজে বের করেছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিস্ট স্টেফান ডারকন। প্রথমটি হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্পের অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলা। ১৯৮৪ সালে পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ মাত্র ৩ কোটি ২০ লাখ ডলার আয় করেছিল। সেই আয় এখন ৩৪ বিলিয়ন (৩ হাজার ৪০০ কোটি) ডলারে পৌঁছেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে যে আয় করেছে, তা আফ্রিকার ৫৪টি দেশের সম্মিলিত আয়ের দ্বিগুণেরও বেশি। দ্বিতীয়টি হলো রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা গত বছর ২২ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। আর তৃতীয় কারণটি হচ্ছে ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বেসরকারি সংস্থার ভূমিকা, যারা নিরাপত্তাবেষ্টনী প্রদান করে এবং দরিদ্র মানুষকে ওপরের দিকে উঠে আসতে সহায়তা করে চলেছে।

এ বিষয়ে ডেরকন তার গ্যাম্বলিং অন ডেভেলপমেন্ট বইতে লিখেছেন, বাংলাদেশের সরকার সব সময় রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পকে রপ্তানি বাড়াতে অব্যাহতভাবে সহায়তা দিয়ে এসেছে। এনজিওগুলোকে বিনা বাধায় কাজ করতে দিয়েছে। এ কথাও ঠিক যে বাংলাদেশ তাদের নিজেদের সস্তা শ্রমকে শোষণ করে কখনও কখনও ভয়ংকর মূল্য দিয়েছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে এক হাজারের বেশি গার্মেন্টস শ্রমিক পিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিল। আবার এটাও ঠিক যে প্রতিটি শিল্পোন্নত দেশেই এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটেনের মড়কপূর্ণ ভিক্টোরিয়ান বস্তিসহ জাপানের মিনামাতা পারদ বিষাক্ত কেলেঙ্কারি পর্যন্ত একই রকম ভয়াবহতা পেরোতে হয়েছে।

রেনেসাঁ ক্যাপিটালের প্রধান অর্থনীতিবিদ চার্লি রবার্টসনও বাংলাদেশের উন্নয়ন সাফল্যের পেছনে তিনটি কারণ তুলে ধরেন। এ তিনটি হচ্ছে- সাক্ষরতা, বিদ্যুৎ এবং প্রজননক্ষমতা। রবার্টসন তার দ্য টাইম ট্র্যাভেলিং ইকোনমিস্ট বইতে লিখেছেন, শিল্প খাত এগিয়ে যাওয়ার পূর্বশর্ত হলো প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষরতা ৭০ শতাংশের ওপরে থাকা, মাথাপিছু ৩০০ কিলোওয়াট ঘণ্টার ওপরে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং প্রজননক্ষমতা তিনের নিচে থাকা। এসব পরীক্ষায় বাংলাদেশ পাস করেছে।

চার্লি রবার্টসন তার বইতে আরও লিখেছেন, আফ্রিকার অনেক দেশে সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশের ওপর, যার অর্থ তাদের তৈরি কারখানার কর্মী বাহিনী রয়েছে। কিন্তু খুব কম দেশই প্রতিযোগিতামূলক হারে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পেরেছে। বেশির ভাগ দেশ যেমন- গিনি বিসাউ (মাথাপিছু ২১ কিলোওয়াট ঘণ্টা), ইথিওপিয়া (৮২ কিলোওয়াট ঘণ্টা)) এবং নাইজেরিয়া (১৫০ কিলোওয়াট ঘণ্টা) এটা পারেনি।

রবার্টসন যুক্তি দেখিয়েছেন, কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না, যতক্ষণ না সেই দেশের প্রজনন হার তিনের নিচে নেমে আসে। যদিও এটি নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে পরিবারের আকার, পরিবারের সঞ্চয় এবং শিল্পের জন্য ব্যাংকঋণের প্রাপ্যতা এবং সামর্থ্যের মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে ঋণের হার ৩৯ শতাংশ, নাইজেরিয়ায় ১২ শতাংশের নিচে।

শেষে ডেভিড পিলিং লিখেছেন, বাংলাদেশ আজ যেখানে ১৯৭৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়া সেই অবস্থানে ছিল। তখন সেটি একটি অলৌকিকতার শীর্ষে ছিল। সেই অলৌকিকই এখন বাস্তবে রূপ দিচ্ছে বাংলাদেশ। সরকারগুলোর সততা এবং অগ্রসর চিন্তা এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয় বটে, তবে বাংলাদেশ দেখিয়ে দিচ্ছে, সমৃদ্ধির একটি মিশ্র পথও আছে।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.