মিতা হকের স্মৃতিতে । ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম

0

আমার অন্তর্মান্য শ্রদ্ধেয় শিল্পীর একজন ছিলেন মিতা হক, শুধু আমার নয়, দুই বাংলায়ই মিতা ছিলেন সংগীতভক্তদের কাছে এক বরেণ্য নাম। কাল তিনি চলে গেছেন। করোনায় তাঁকে ছিনিয়ে নিলো গানের মায়াপুরী থেকে।
রবীন্দ্রসংগীত তাঁর প্রধান মগ্নতার জায়গা হলেও পঞ্চকবির অন্য চার জনের গানও তিনি গাইতেন সমান মুগ্ধতায়। তাঁকে শুনতে শুনতে এ বাণীই একান্তে মনে আসত, ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হলো শেষ’। সঙ্গীত যে শুক্ষ্মতম কলা, মানবের হৃদয় হরণের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম, মিতার গান শুনলে তাই মনে হতো বার বার। সুর প্রয়োগে তাঁর স্বরলিপিক পরিমিতি, আপন বশে থাকা শীলিত কণ্ঠ, সুরের চিত্ররেখায় গানকে ফুটিয়ে তোলার বিশেষ কলাশৈলী তাঁকে উঁচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। সত্যিকারার্থে হৃদয়ে গানকে ধারণ করা না গেলে তো গান স্বার্থক হতে পারে না, ‘হৃদয়ে হৃদয় যোগ করা/না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পশরা।’
গানকে যে কত অকৃত্রিম আবেগে ধারণ করতেন মিতা, তার কিছু ঘনিষ্ট স্মৃতি ছিল তাঁর সাথে।
আমি ওঁর সাথে দেশের বাইরে একটা সংস্কৃতিক ডেলিগেশনে গিয়েছিলাম। ভিয়েতনামে। সাথে ছিলেন আরো জনা দশেক বিভিন্ন পারফর্মার। আমি তখন শিল্পকলার ডিজি। মিতা মনোনীত হয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের জন্য।
আমরা ভিয়েতনামী দর্শকদের মাতিয়েছিলাম গানে, নৃত্যে, বাঁশিতে।
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতাম ওদের দেয়া চমৎকার একটি মাইক্রোবাসে। হ্যানয় থেকে বিশ্বখ্যাত হউ লং বে-র মতো দূরের শহরেও আমরা গেছি এক সাথে। মিতা আমার পাশেই বসতেন। গলা ছেড়ে গান গাইতেন পথে এই নিরহংকার উঁচু মাপের মানুষটি। শত শত রবীন্দ্রসংগীত তাঁর অন্তরে জমা ছিল। কোনো একটির অনুরোধ করলেই তিনি শুনিয়ে দিতে পারতেন। রবীন্দ্রসংগীতের আধ্যত্মদর্শন ও ভাবমাধুরী নিয়ে আমরা কথা বলেছি। তিনি সে মাধুরীতে অবগহন করা এক শিল্পী ছিলেন। গান বুঝে গাওয়াটা শিল্পী হিসেবে তাঁকে স্বার্থক করেছিল।
মিতার সাথে আমার ছিল পরষ্পর শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। মাঝে আমার ম্যাসেঞ্জারে তিনি গান পাঠাতেন। অন্যের গানও, যা তাঁর ভালোলাগার। কোভিড‌ নি‌য়ে তিনি আমাকে সতর্ক করতেন। প্রজ্বলিত মোমাশিখা দি‌য়ে করোনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে আশার আলোর ছবিও পাঠাতেন তিনি। ছিল কৌতুককর পোষ্টও যেমন, গৃহিনীকে স্বামী ভর্ৎসনা করছেন, ‘কী পাকাও, কোনোই স্বাদ পাচ্ছি না।’ ভীত স্ত্রী করোনা সেন্টারে ফোন দিয়েছেন, ‘শীঘ্র আসুন, আমার স্বামী খাবারে কোনো টেস্ট পাচ্ছেন না’। অমনি এ্যামবুলেন্স এসে তাঁকে তুলে নিয়ে গেল। কারন খাবারে স্বাদ না পাওয়া করোনার প্রধান লক্ষণ।
এ পোষ্ট দিয়ে মিতা আমাকে আবার সাবধান করছেন, ‘খবরদার সফিক ভাই, ভাবির পাকে স্বাদ না পেলেও কোনো কথা বলবেন না।’
মিতা আমার ফেসবুকের পোস্টগুলো পড়তেন গভীর আগ্রহে। আমার অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদ বিরোধী লেখার প্রশংসা করতেন ম্যাসেঞ্জারে এসে। সংগীত ও সংস্কৃতিবিরোধী হেফাজতি তাণ্ডবে তিনি ছিলেন সমধীক বিচলিত। এমন কি তসলিমার লেখাও তিনি পাঠাতেন। ‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতি যে নষ্ট হয়েছে এ দেশের বুদ্ধিজীবিদের কারণে, তসলিমার এ বিশ্লেষণের সাথে আমরা দু-জন ছিলাম সহমত।
গণতন্ত্রের হতচিত্র আর উগ্রসাম্প্রদায়িকতার উত্থান নিয়ে একটা হতাশার মধ্যেই তীরোধান ঘটল এই পরিশ্লিত, সমাজদরদি, সংবেদনশীল গুনি শিল্পীর।
আমার মনে হয় না মৃত্যুতে সব ফুরিয়ে যায়।
যিনি সব সঁপে দেন প্রভুর পায়, তাঁর ক্ষয় নেই। মিতা তেমনই একজন। মিতার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে শেষ করি :
ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে
অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে।
তিনি অস্ত সাগর পেরিয়ে নতুন আলোর দেশেই উত্তীর্ণ হয়েছেন, এই বিশ্বাস আমরা রাখতে পারি।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি ও কলাম লেখক

১১’০৪.২০২১

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.