বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কারণ ও উদ্দেশ্য – হীরেন পণ্ডিত

পর্ব-২

0

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বাঙালি জাতির জীবনে এক বেদনাবিঁধূর ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই দিনে দেশ-বিদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে বাঙালি জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ হন। সেদিন আরো শহীদ হন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, তিন ছেলেসহ পরিবারের উপস্থিত সব সদস্য, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি কৃষক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের সদস্যরা এবং বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার পরিবারের সদস্যরা। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ শেখ মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীও সেদিন রেহাই পাননি। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিলও নিহত হন। কামানের গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরে ১৩ জন নিরীহ মানুষও সেদিন নিহত হন। এ ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ভাগ্যক্রমে সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন যাদের হত্যা করা হয়েছিল তারা প্রত্যেকেই ছিলেন অত্যন্ত ভালো মানুষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চরম শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অবমুক্ত করা দলিলের ভাষ্যমতে, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে কতগুলো খাঁটি দেশপ্রেমিক ও সৎ লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাদের প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু তাদের দেশপ্রেম ও সততা প্রশ্নাতীত।’

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের আন্তর্জাতিক প্রভুদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকেন এবং বাংলাদেশের চরম ডান ও বামপন্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আমেরিকান গবেষক ও লেখক স্টেনলি ওলপার্টের মতে, ‘ভুট্টো দুই বছর ধরে আব্দুল হকসহ অন্যান্য মুজিববিরোধী দলকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য অব্যাহত রাখেন এবং বিনিময়ে ১৯৭৫ সালের আগস্টে ফল লাভ (মুজিব হত্যা) করেন।’ দুই বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধাচরণ করায় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তাদের নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রথম বিপ্লব তিন বছর পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু নতুন যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে উদ্যোগী হন, তাকে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মধ্যে ছিল সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা, সব দল বিলুপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব দল ও সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটি জাতীয় দল গঠন, চারটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার অনুমতি, মহকুমাগুলোকে জেলায় উন্নীত করা, জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে জনপ্রতিনিধি বা গভর্নর নিয়োগ, সমবায়ভিত্তিক কৃষি উৎপাদন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পল্লী অঞ্চলে হেলথ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদি।

বঙ্গবন্ধু কর্তৃক দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেয়ার একটি পটভূমি রয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকারকে এক চরম বৈরী অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। সশস্ত্র ডাকাতি, লুটতরাজ, ঘুষ, দুর্নীতি, কালোবাজারি, মজুদদারি, ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি নবগঠিত সরকারের পক্ষে মোকাবেলা করা খুবই কঠিন ছিল। তৎকালীন চরম বামপন্থী কিছু সংগঠন যেমন সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টি, আব্দুল হকের পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, আ স ম আব্দুর রবের জাসদসহ আরো কিছু চরমপন্থী দল থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, বাজার ও ব্যাংক লুট, পাটের গুদামে আগুন, রেললাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলা, শ্রেণী শত্রু খতমের নামে মানুষ হত্যা, সংসদ সদস্য হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে কার্যত সরকারের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অধিকন্তু আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে চরম অনৈক্য, কিছু নেতাকর্মীর সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতিপরায়ণতার কারণেও বঙ্গবন্ধু অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ওই সময় বিভিন্ন বক্তৃতায় আক্ষেপ করে বলতেন, ‘সবাই দেশ স্বাধীন করে পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’। এমন রাজনৈতিক পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা করেন। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে বহু মানুষের প্রাণহানি এবং এ নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও বঙ্গবন্ধুকে বিকল্প কিছু ভাবতে উৎসাহিত করে। তিনি একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসক হওয়ার অভিলাষ থেকে সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন করেননি।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পায়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটে এবং গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার কৃষিজাত ফসল ও পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের তথ্য অনুসারে ’৭৪-৭৫ সালে দেশে সামষ্টিক আয়ের প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬.৫-৭.০ শতাংশ হয়, যেটি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। তার পরও ষড়যন্ত্রকারীরা বাকশাল সম্পর্কে অপপ্রচার চালাতে থাকে এবং জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। তিনি ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার আগে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় একজন সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দাঙ্গা আক্রান্ত মানুষের জীবন রক্ষার্থে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। এ দাঙ্গা তার মনে ভীষণ দাগ কাটে। মুক্তিযুদ্ধের পর সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট বক্তব্য: ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন-নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনোদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না।’ ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ অর্থ ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান ইসলাম ধর্ম পালন করবে। হিন্দু হিন্দু ধর্ম পালন করবে। খ্রিস্টান তাদের ধর্ম পালন করবে। কেউ কাউকে বাধা দিবার উচিত না, দিতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গিকে ষড়যন্ত্রকারীরা ধর্মহীনতা বা নাস্তিকতা বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে এবং দেশে ও বিদেশে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অথচ বঙ্গবন্ধু কখনই ইসলাম বা ধর্মবিরোধী ছিলেন না। স্রষ্টার প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস। ৭ মার্চের ভাষণেও তার স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। স্রষ্টার প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখেই ‘ইনশাআল্লাহ’ দিয়ে তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সমাপ্তি টানেন।

১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা কোনো গুরুতর অপরাধ অর্থাৎ হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেনি, শুধু তাদের ক্ষমা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগারে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে বন্দি ছিল। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে রাতারাতি সব যুদ্ধাপরাধীকে মুক্ত কওে দেয়া হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করার ফলে রাজাকাররা সমাজে বুক ফুলিয়ে হাঁটে আর মুক্তিযোদ্ধারা নত হয়ে ভিক্ষা করে। শহীদ পরিবারের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। মানবতা লঙ্ঘনকারীদের অন্যায় কাজ করতে আরো উৎসাহ জোগায়।

তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর আমলে নিষিদ্ধ মদ, জুয়া, হাউজি ও ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আবার চালু হয়। বাকশাল বাতিল করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সময় ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ ছিল, তা পুনরায় বহাল করা হয়। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে খুনি চক্রের প্রধান খন্দকার মোশতাক কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। সামরিক শাসকরা বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করে। গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ করতেও তারা দ্বিধা করেনি। এক কথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মূল্যবোধ, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশ পরিচালিত হতে থাকে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে যায়। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা উঠিয়ে দেয়া হয়। দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও শক্তির উত্থান ঘটে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তারা অধিষ্ঠিত হয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.